মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট এখন কুড়িগ্রাম
# মাদক আসার প্রধান উৎস হুন্ডির টাকা
# রাতের বেলা সীমান্তে লাইটের আলো কমিয়ে দেয় বিএসএফ
# মাদক বহনে ব্যবহার হচ্ছে নারী-পুরুষ, যুবক, কিশোর ও শিশুদের
# মাদক বহনে বেশি যুক্ত নারীরা
কুড়িগ্রাম এখন মাদকদ্রব্য পাচারের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। সড়ক ও নৌপথ ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন ইয়াবা, গাঁজা ও মদসহ বিভিন্ন মাদক পাচার হচ্ছে।
দেশের উত্তরের নদ-নদী আর সীমান্ত বেষ্টিত সর্বশেষ জেলা কুড়িগ্রাম। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলার সাথে ভারতের তিনটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে ২৭৮.২৮কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৩২ কিলোমিটার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। নদীপথ রয়েছে ৩১৬ কিলোমিটার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যের সীমানায় কুড়িগ্রাম-২২ বিজিবির অধীনে ১৯৮ কিলোমিটার সীমান্ত রেখা। জামালপুর-৩৫ বিজিবির আওতায় সীমানা প্রায় সাড়ে ৪৬ কিলোমিটার। কাঁটাতারের ওপারে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানায় লালমনিরহাট-১৫ বিজিবির অধীনে ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত।
ফলে প্রতিদিনেই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ মাদক। এর মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহনে সহজ হওয়া সবচেয়ে বেশি আসছে ইয়াবা। আর মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে সীমান্তবর্তী এলাকার গরিব-নিরীহ মানুষদের। মাদক বহনে ব্যবহার হচ্ছে নারী-পুরুষ, যুবক, কিশোর ও শিশুদের। এতে করে মাদক প্রতিরোধে এক প্রকার হিমশিম খেতে হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীদের।
ইতোমধ্যে রৌমারী উপজেলা দিয়ে নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারী চক্রগুলো। এখানে ভারতের আসাম-মেঘালয় রাজ্যের নিকটবর্তী পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অনায়াসে আসছে ইয়াবার বড় বড় চালানসহ গাঁজা। রাতের আধারে বিএসএফসহ ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য পার করে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ী সীমান্তের লোকজনকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মাদকদ্রব্য নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ৭টি উপজেলার প্রায় ৬০টি পয়েন্ট এবং ভারতের ৪৫টি পয়েন্ট দিয়ে আসে মাদক। আর এসব মাদকদ্রব্য একাধিক হাতবদল হয়ে চিলমারী-রৌমারী এবং রাজিবপুর দিয়ে নৌ-সড়ক পথে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নতুন কৌশল অবলম্বন করে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য সীমান্ত দিয়ে নিয়ে আসছে মাদক পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট চক্র। এসব পয়েন্টে ভারত-বাংলাদেশের প্রায় দুই সহস্রাধিকেরও বেশি রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী। আর রৌমারীতেই ছোট-বড় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি।
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, সীমান্তবর্তী ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের মদদে ক্রমেই বাড়ছে মাদকের ব্যবসা। কম পরিশ্রমে অধিক টাকা পাওয়ায় প্রতিদিনিই নতুন নতুন মুখ মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধি করায় পাচারকারীরা নতুন কৌশল হিসেবে কিছু মাদক নিয়ে ধরা পড়ার অভিনয় করে বড় বড় চালান পার করে নিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্ধ লেনদেন করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইয়াবা সিন্ডিকেট চক্র হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাঠাচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মদসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহন সহজলভ্য হওয়ায় অন্যান্য সীমান্তর তুলনায় রৌমারী দিয়ে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে।
একাধিক সূত্র, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী জানায়, মাদক আসার প্রধান উৎসই হলো হুন্ডির টাকা। এই হুন্ডির টাকা বন্ধ করা গেলেই মাদক ব্যবসা অনেকাংশে কমে যাবে।
রৌমারীর আলগারচর সীমান্তে ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ী হলেন, ধুবড়ি জেলার মানকার চর থানার ফকিরবাট গ্রামের আমিরুল হক, সোনা মিয়া, ঝগড়ার চরের জহুরুলসহ প্রায় ৭-৮শ জন। তারা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদক সরবরাহ করে।
বর্তমানে এখানে মাদক চক্রের মূল হোতার পুরো নাম-ঠিকানা না বললেও তারা জানায়, মূলহোতা জামালপুরের বাসিন্দা।তিনি দেশের সব মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। তার লোকজন দিয়ে ইয়াবাসহ মাদকের বড় বড় চালান পার করে নিয়ে আসছে ভারত থেকে। সীমান্তে ভারতীয় সিম ব্যবহার করে বাংলাদেশি-ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা আলাপচারিতা করে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে পারে না কারা এগুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বিএসএফ কিংবা মাদক ব্যবসায়ীরা ফোনে যোগাযোগ করে দিনে বা রাতের বেলায় ক্রিকেট বলের মতো স্কচ টেপ পেঁচিয়ে, সিগারেটের প্যাকেটে করে, প্লাস্টিকের ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ইয়াবা কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ঢিল মেরে ফেলে দেয়। আর বহনকারীরা সংকেত পেয়ে কৃষক বা রাখালের ছদ্মবেশে এসব মাদক নিয়ে আসছে অনায়াসে।
নিরাপদ স্থানে মাদক পৌঁছানোর জন্য ৫-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় খাটচ্ছে সীমান্ত এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা। এতে সীমান্তের অনেকেই রাতারাতি সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। সীমান্ত এলাকায় অর্থের লোভে পড়ে স্থানীয়রা জড়িয়ে পড়ায় জেলার অধিকাংশ এলাকায় মাদক এখন সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। অনেকেই মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে ফেরত আসলেও মাদক বন্ধে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে নারাজ।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বিজিবি সদস্য জানান, আলগারচরে সিংহভাগ মানুষই মাদক ব্যবসার সাথে জরিত। রাতের বেলা বিএসএফ সীমান্তে লাইটের আলো কমিয়ে দিয়ে ইয়াবা পাচার করে। আমাদের বিজিবি টহল টিম বের হলে স্থানীয় মাদককারবারিরা ফোনে জানিয়ে দেয়। ফলে টহল টিমের বিপরীত দিকে পাচার করে। এখানে ইয়াবা পাচারে নারীরাই বেশি জড়িত। কেননা তারা গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে ইয়াবার প্যাকেট বুকের মধ্যে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে পার করে থাকে। স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ায় মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলে বিজিবিসহ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেমে পড়ে। বিওপির সাথে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। সোর্সের মাধ্যমে মাদক পাচারের খবর পেলেও যেতে না যেতে তারা পালিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। গ্রামের কাচা রাস্তাগুলো খাল খন্দে ভরা। ফলে কাদামাটিতে টহল দিতে গিয়ে অনেক নাস্তানাবুদ হতে হয় বিজিবি সদস্যদের।
পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান জানান, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ অভিযান জোরদার করা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীসহ মানি লন্ডারিংয়ের সাথে যারা জড়িত তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
নাজমুল হোসেন/এমএসএইচ