৩ শিক্ষককে পথে বসালেন সেই অধ্যক্ষ
শিক্ষক নিবন্ধন সনদ না থাকা সত্ত্বেও টাকার বিনিময়ে তিন শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছেন রাজশাহীর মহানগর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জহুরুল আলম রিপন।
এমপিওভুক্ত হয়ে বছর তিনেক চাকরি করেন ওই তিন শিক্ষক। কিন্তু জালিয়াতি ধরা পড়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের তদন্তে। এরপর এমপিও স্থগিত হলে চাকরি হারান তারা। এসএসসি ভোকেশনাল শাখার কর্মরত ছিলেন ওই তিন শিক্ষক।
ওই তিন শিক্ষকের অভিযোগ, তারা জালিয়াতির কিছুই জানতেন না। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অধ্যক্ষ জহুরুল আলম রিপন জমা দিয়েছেন। চাকরি না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন।
জেলার বাঘা উপজেলার বারোখাদিয়া এলাকার মৃত রেজাব উদ্দিন প্রামাণিকের ছেলে গোলাম মোস্তফা এগ্রোবেসড ফুড ট্রেডের ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পান প্রতিষ্ঠানটিতে। একই প্রতিষ্ঠানে ফিস কালচার ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন তার স্ত্রী সাকিয়া শিরিনও। এছাড়া একই উপজেলার লোকমানপুর বখতিয়ারপাড়ার বাসিন্দা সেলিনা আক্তারকে নিয়োগ দেয়া হয় এগ্রোবেসড ফুড ট্রেডে। এই তিনজনের নিয়োগ হয়েছিলো ২০১২ সালের ৬ মে। ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর তাদের এমপিও স্থগিত হয়ে যায়।
শিক্ষকরা জানান, নিয়োগের সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে অগ্রিম নিয়েছিলেন অধ্যক্ষ রিপন। তাদের শিক্ষক নিবন্ধন সনদও ছিল না। কে কোন পদে নিয়োগ পাচ্ছেন তাও জানতেন না। পরে বিষয়টি অনুমোদনের নামে আরও প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেন অধ্যক্ষ।
এই তিন শিক্ষকের অভিযোগ, অধ্যক্ষ নিজেই তাদের জাল নিবন্ধন সনদ তৈরি করে অধিদফতরে জমা দিয়েছিলেন। পরে তাদের এমপিওভুক্ত করিয়ে আনেন নিজেই। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের তদন্তে এই জালিয়াতি ধরা পড়ে যায়। শেষে চাকরি হারান তিন শিক্ষক।
জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অধ্যক্ষের জালিয়াতির কারণে আমাদের চাকরি নেই প্রায় দুই বছর। দফায় দফায় অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ নেই। কর্মহীন হয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছি। এ ঘটনার বিচার দাবি করেন এই শিক্ষক।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমপিও স্থগিত হওয়ার পর সংক্ষুদ্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ওই তিন শিক্ষক। পরে আদালত ওই স্থগিতাদেশের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির নথিপত্র নিয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এরই প্রেক্ষিতে ওই প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষসহ ওই তিন শিক্ষককের কাছে চিঠি পাঠায় কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর। তাতে এনটিআরসির প্রত্যয়নপত্রসহ শিক্ষকদের মূল নিবন্ধন সনদের অনুলিপি, নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন বহি, নিয়োগ ও যোগদানপত্র, নিয়োগ পরীক্ষার মূল মার্কশিট, টাইমস্কেল প্রাপ্তি সংক্রান্ত তথ্য, সকল সনদের মূলকপিসহ বিভিন্ন নথিপত্র চেয়ে পাঠায় অধিদফতর।
এরই প্রেক্ষিতে তাদের সনদ সঠিক রয়েছে মর্মে এনটিআরসিএ’র সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমেদের নামে ভুয়া প্রত্যয়নপত্র জমা দেন অধ্যক্ষ। সত্যতা যাচাইকালে এই জালিয়াতিও ধরে ফেলে অধিদফতর। এ সময় ওই তিন শিক্ষকের অন্যান্য নথিপত্র জমা দেননি অধ্যক্ষ। পরে রহস্যময় আগুনে সেগুলো পুড়ে যাওয়ার খবর দেয়া হয় অধিদফতরে। কয়েক দফা ডেকেও অধ্যক্ষকে পায়নি অধিদফতর। পরে এনিয়ে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও অধ্যক্ষ জহুরুল আলম রিপনের
মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ওই তিন শিক্ষকের সদন জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (এমপিও) জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ওই তিন শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর তাদের যাবতীয় নথিপত্র চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো দেননি অধ্যক্ষ। ফলে বিষয়টি ওই অবস্থায় রয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিজ অফিস কক্ষে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ রিপন। ঘটনার চারদিনের মাথায় ওই ছাত্রীসহ আরও দুই ছাত্রী এবং এক শিক্ষিকা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ দেন।
এছাড়া আর্থিক অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরাও। অভিযোগ তদন্ত হলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
অপহরণ ও ধষর্ণচেষ্টার অভিযোগে ৮ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই আরেক ছাত্রী। ওই দিনই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। এর পাঁচদিনের মাথায় ১৩ মার্চ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান অধ্যক্ষ রিপন।
ছাত্রী অপহরণ ও ধষর্ণচেষ্টায় তাকে অভিযুক্ত করে গত বছরের ৪ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর বিধি ভেঙে তাকে স্বপদে ফেরান পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকা পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ নেওয়াজ।
কলেজে ফিরেই তার অপকর্মের প্রতিবাদ করা শিক্ষক-কর্মচারীদের দমন-পীড়ন শুরু করেন অধ্যক্ষ। সম্প্রতি কলেজের এক শিক্ষককে অফিস কক্ষে নিয়ে হত্যার চেষ্টা চালান। এনিয়ে ওই শিক্ষক সাধারণ ডায়েরি করেন। অধ্যক্ষের অব্যহত হুমকির মুখে প্রাণভয়ে প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন ওই শিক্ষক।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর/এমকেএইচ