৪৮ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা, এবার পথে বসেছেন বাদশা
উত্তরের আট জেলার সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কালীবাড়ি হাট। দেশের বিভিন্ন জেলার খুচরা বিক্রেতা ও পাইকাররা এ হাটে চামড়া বিক্রি করতে আসেন।
ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ট্যানারি মালিক ও পাইকাররা এখানে ট্রাক নিয়ে আসেন খুচরা ও পাইকারদের কাছ থেকে চামড়া কেনার জন্য। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। চামড়া নিয়ে বাজারে বসে থাকলেও নেই কোনো ক্রেতা।
বুধবার (২১ আগস্ট) এখানে হাট বসলেও ছিল না কোনো ক্রেতা। বিগত বছরগুলোতে যে চামড়া ১ হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল এবার সেই চামড়ার দাম উঠেছে মাত্র ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ছাগল আর খাসির চামড়া পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরকারের তদারকির অভাব থাকায় চামড়ার এমন দরপতন হয়েছে। এ অবস্থায় চামড়া কিনে দেউলিয়া হয়ে জমি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন স্থানীয় খুচরা বিক্রেতা ও পাইকাররা।
পলাশবাড়ী উপজেলা খোদ্দ কোমরপুর ইউনিয়নের তালুক হরিদাস গ্রামের ৭৪ বছর বয়সী বাদশা ব্যাপারী। ১৯৭১ সালের পর থেকে গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিক্রি করে আসছেন।
কাঁচা চামড়ায় লবণ দিয়ে বাজারজাত করতে যা প্রয়োজন সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চামড়া বিক্রি করে ভালোই আয় হতো তার। ওই আয়ে ভালোভাবেই চলছিল তার সংসার। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে তার চামড়ার ব্যবসায় ধস নেমেছে। এবারও জমি বিক্রি করে চামড়া কিনেছেন তিনি। চামড়ার ব্যবসা করতে গিয়ে গত তিন বছরে ছয় বিঘা জমি বিক্রি করেছেন। এবার জমি বিক্রির টাকায় চামড়া কিনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন বাদশা ব্যাপারী।
বাদশা ব্যাপারী বলেন, ৪৮ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। চামড়ার ব্যবসার জন্য ছয় বিঘা জমি বিক্রি করেছি। এ বছর আশার আলো জ্বলবে বলে চামড়া কিনেছি। সরকার নির্ধারিত মূল্যেরও কম অর্থাৎ ৩০০ টাকা পিস চামড়া কিনে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছি না। আমার জীবনেও চামড়ার এমন দরপতন দেখিনি। ফকির হয়ে রাস্তায় বসে গেলাম আমি। সরকার যদি চামড়া ব্যবসায়ীদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে চামড়া ব্যবসা আলোর মুখ দেখবে না।
জয়পুরহাট থেকে আসা চামড়া ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে গরুর চামড়া কিনে বড় বিপদে পড়ে গেলাম ভাই। ২০ টাকা কেজি লবণ ও পরিবহন খরচ দিয়ে পলাশবাড়ী হাটে চামড়া এনে বিক্রি করতে পারিনি। আমরা অসহায় হয়ে পথে বসলাম।
লালমনিরহাটের চামড়া ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান আতিক বলেন, চামড়া বিক্রি করতে এসে মহাবিপদে আছি। প্রতিটি চামড়া যে দামে কিনেছি তার চেয়েও কম দাম বলছেন ক্রেতারা। চামড়া ব্যবসায় লাভ তো দূরের কথা চালানই শেষ।
এদিকে, ছাগল ও খাসির চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রি করতে এনে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রক্রিয়াজাত ছাগল ও খাসির চামড়া পাঁচ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
ছাগলের চামড়ার ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, এ বছর ২০ হাজার টাকার খাসির চামড়া কিনে ১০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। বাকি ১০ হাজার টাকা শেষ আমার। আর চামড়া কিনব না।
পলাশবাড়ীর চামড়া ব্যবসায়ী আবুল ব্যাপারী বলেন, আর কখনো চামড়ার ব্যবসা করব না। এই ব্যবসা করতে গিয়ে গত তিন বছরে সংসার মাটি হয়ে গেছে আমার। চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, কোনো ট্যানারি মালিক চামড়া কিনতে আসেনি। আমরা আর কখন এসব চামড়া বিক্রি করব। আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলে আমাদের বার বার লোকসান হবে, আর বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কম দামে চামড়া কিনে লাভ করবে। চামড়া কিনে আমি ফকির আর তারা কোটিপতি।
বগুড়ার মোকামতলার চামড়া ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল আলম ৬১০ পিস গরুর চামড়া কিনে বাজারে বিক্রি করতে এসে বিপদে পড়েছেন। চামড়ার দাম কমের কারণে নানা চিন্তায় সময়মতো লবণ দিতে না পারায় চার লাখ টাকার চামড়া পচে গেছে তার। পচা চামড়া পলাশবাড়ীর হাটের এক পাশে রেখে নীরবে কাঁদছেন মঞ্জুরুল আলম।
পলাশবাড়ীর কালিবাড়ী চামড়ার হাটের ইজারাদার শফিকুল কবির মিন্টু বলেন, চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় টোল আদায় কম। বুধবার (২১ আগস্ট) সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত একটি চামড়ার চালানও বিক্রি হয়নি। এভাবে চললে আগামীতে হাটের ইজারা হারাব আমরা। তাই চামড়া ব্যবসায়ীদের দিকে সরকারের সুনজর দেয়া জরুরি।
জাহিদ খন্দকার/এএম/এমএস