কেউ স্মরণ করে না তাদের
‘তোরা কিসের মিলাদের আয়োজন করেছিস, এত বড় সাহস, এখন জেলে যেতে হবে।’ পুলিশ সদস্যরা এসব কথা বলেই সবাইকে লাঠিপেটা শুরু করে। পায়ের বুট আর অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাত করতে থাকে যুবলীগ নেতাকর্মীদের ওপর। পুলিশের নির্যাতনে সেদিন অনেকেই রক্তাক্ত হয়। উপস্থিত কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত পায়নি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট ভৈরবে জাতির জনকের প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছিল। এদিন বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২২ জন নেতাকর্মী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে তাদেরকে ভৈরব থানায় নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর জেলে পাঠানো হয়। তাদের অপরাধ ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদ পড়ানো। তারপর দীর্ঘদিন কারাভোগের পর পর্যায়ক্রমে তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
সেই সাহসীদের কথা ভৈরবে এখন কেউ আর স্মরণ করে না। ১৫ আগস্টের দলীয় অনুষ্ঠানে তাদের অনেকেই দাওয়াত কার্ডও পাননি। হয়তো ভৈরবের এই ঘটনাটি দেশবাসীরও অজানাই থেকে গেছে। তারা আজ অবহেলিত।
সেদিন যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা হলেন তৎকালীন ভৈরব যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম আক্কাছ (বর্তমানে ভৈরব পৌরসভার মেয়র), আসাদুজ্জামান ফারুক (বর্তমানে জাগো নিউজের সাংবাদিক), রুহুল আমিন, মাহাবুব, মতিউর রহমান, মফিজুর রহমান, মোশারফ হোসেন (জজ মিয়া), জিল্লুর রহমান জিল্লু, আসাদ মিয়া, আতাউর রহমান, আসাদুল হক শিশু, ফিরুজ মিয়া, দীলিপ চন্দ্র সাহা ও তার ভাই দীজেন্দ্র চন্দ্র সাহা, ফজলুর রহমান, আবদুল হামিদ, ইদ্রিছ মিয়া, মাহবুব আলম, রসরাজ সাহা, সুবল চন্দ্র কর, শাহজালাল হোসেন ও আজমল ভূইয়া।
সেদিন গ্রেফতার হওয়া ২২ জনের মধ্য ৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে। এদের কয়েকজনের পরিবার এখনও দুঃখ কষ্ট ও দরিদ্রতার কষাঘাতে দিন কাটাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর ৪৪ তম শাহাদাৎবার্ষিকী আজ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ ঘাতকদের হাতে নিহত হন। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তখন সমরিক আইন প্রশাসক ছিলেন জিয়াউর রহমান। তৎকালীন সামরিক সরকারের ভয়ে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করতে পাতেন না। অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সেই সময়ে কারাগারে বা আত্মগোপনে ছিলেন। এই দুঃসময়ে ভৈরবের ২২ জন নেতাকর্মী তৎকালীন হাজী আসমত কলেজের শহীদ আশুরন্জন ছাত্রাবাসে (বর্তমান শৈবাল হোটেল) বঙ্গবন্ধুর প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলেন। শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল, কোরআন খতম ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন। দুপুরের পর বিকেল সাড়ে ৩টায় ১২ জন মৌলভি ছাত্রাবাসে এসে কোরআন খতম শুরু করেন। বিকেল ৪টার মধ্যে একে একে ২২ জন নেতাকর্মী মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। নিমন্ত্রণের সময় ভৈরবের অনেকেই মিলাদে আসার কথা ছিল কিন্তু সামরিক সরকারের ভয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেই মিলাদে উপস্থিত হননি।
মিলাদ শুরু আগেই গোয়েন্দাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। তখন সামরিক সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ খবর পৌঁছানো হলে তাৎক্ষণিক ওয়ারলেস মেসেজ পেয়ে ভৈরব থানার ৪০/৫০ জন পুলিশ ছাত্রাবাসটি ঘিরে ফেলে। পুলিশ ছাত্রাবাসে প্রবেশ করেই কোরআনগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নেতাকর্মীদের মারধর ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। এরপর ২২ জনকে থানায় নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। উপস্থিত মৌলভীদের সেদিন মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
সেদিনে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান ফারুক বললেন, মিলাদ পড়ানোর অপরাধে গ্রেফতার হবো তখন ভাবতেও পারেনি। এই অপরাধে সেই সময় ৬ মাস কারাগারে ছিলাম। ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতারা মিলাদ পড়াতে সাহস পাননি। এখন দল ক্ষমতায় তাই অনেক নেতাই বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে কিন্তু আমরা দলের কাছে মূল্যহীন।
সেই সময়ে গ্রেফতার রসরাজ ও ফিরুজ মিয়া এই প্রতিনিধির নিকট দুঃখ করে বলেন, আমাদের কথা এখন কেউ স্মরণ করে না। আমরা আজ অবহেলিত। ১৫ আগস্টের দলীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত কার্ডটি পর্যন্ত আমরা পাই না।
সেদিন ওই আয়োজনের অন্যতম আয়োজক যুবলীগ নেতা ফখরুল আলম আক্কাছ বললেন, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে পরিবারসহ হত্যা করা হয়। আমরা সেদিন তার শাহাদাৎবার্ষিকী পালন করতে পারি নাই। তখন সামরিক সরকারের এতটাই ভয় ছিল বঙ্গবন্ধুর কোনো অনুসারী এদেশে রাখা যাবে না। জাতির জনকের শাহাদাৎবার্ষিকীতে মিলাদের আয়োজন করার অপরাধে সেই সময় এক বছর জেল খেটেছিলাম।
আসাদুজ্জামান ফারুক/এমবিআর/জেআইএম