ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন সুনামগঞ্জ
মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদ উৎসবকে বাড়িয়ে তুলতে ঘুরে আসতে পারেন হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জে। উপভোগ করতে পারবেন ভারতের খাসিয়া, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হাওর আর পাহাড়ের মিলন।
প্রতি বছরই ঈদের সময় সুনামগঞ্জে পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ ভিড় করে। তাছাড়া সারা বছরই এই পর্যটন স্পটগুলো দেশ-বিদেশের পর্যটকরা দেখতে ভিড় করেন। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় এখানে রয়েছে বিখ্যাত ৬টি দর্শনীয় স্থান।
টাঙ্গুয়ার হাওর : সুনামগঞ্জের পর্যটকদের কাছে পরিচিত নাম টাঙ্গুয়ার হাওর। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বিপুল সম্ভাবনা এবং প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য রয়েছে এই হাওরে। মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম টাঙ্গুয়ার হাওর। এক সময় এর এতো পরিচিতি না থাকলেও, বিগত কয়েক বছরে এই হাওর হয়ে উঠেছে ভ্রমণ পিপাসুদের অন্যতম জনপ্রিয় স্থান।
যেভাবে যাবেন : রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন মামুন ও শ্যামলী পরিবহন এবং মহাখালী থেকে এনা পরিবহনের বেশ কয়েকটি ডে-নাইট বাস ছয় ঘণ্টায় সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌঁছায়। সেখানে নেমে সুরমা নদীর ওপর আব্দুর জহুর সেতুতেই লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে সহজেই পৌঁছানো যায় তাহিরপুর। এরপর তাহিরপুর নৌকা ঘাট থেকে আকার এবং প্রশাসন নির্ধারিত নৌকা ভাড়া করে ঘোরা যাবে টাঙ্গুয়ার হাওর।
হাসন রাজার জমিদার বাড়ি : সুনামগঞ্জ পৌরসভা এলাকার তেঘরিয়ায় সুরমা নদীর কূল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হাসন রাজা মূলত ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। মরমী সাধক হাসন রাজা জীবনে অসংখ্য গান রচনা করে আজ অবধি লোকপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাড়িটিতে হাসন রাজার ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগপ্রবণ করে। সুনামগঞ্জ পৌর তেঘরিয়া এলাকায় গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মরমী কবি হাসন রাজা। হাসন রাজার মাজার ও তার জমিদার বাড়িটি দেখার জন্য প্রতি বছরই বহু দর্শনার্থীর সমাগম হয়।
যেভাবে যাবেন : রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন মামুন ও শ্যামলী পরিবহন এবং মহাখালী থেকে এনা পরিবহনের বেশ কয়েকটি ডে-নাইট বাস ছয় ঘণ্টায় সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌঁছায়। সুনামগঞ্জের ট্রাফিক পয়েন্ট থেকে রিকশা বা সিএনজি করে হাসন রাজা বাড়ি বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে সেই দর্শনীয় জায়গাটিতে।
ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ : ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সুনামগঞ্জের ৪৮ জন শহীদদের পরিচয় চোখে ভাসে ডলুরাতে গেলে। পাহাড়ের পাদদেশে চলতি নদীর তীরে লুকায়িত আছে সেই একাত্তরের রক্তত্যাগ সংগ্রামের স্মৃতি চিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী ডলুরা ছিল সুনামগঞ্জের অন্যতম রণাঙ্গণ। এই রণাঙ্গণটি ছিল ৪ নং বালাট সেক্টরের অধীন। এই রণাঙ্গণ সম্মুখ সমরে যেসব মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন, তাদের কয়েকজনকে এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৪৮ জন শহীদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এ ডলুরা শহীদ মাজার। এই মুক্তিযোদ্ধের শহীদদের দেখতে প্রতিবছর ভিড় জমান পর্যটকরা।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ আসবেন। সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর নামক স্থান থেকে সুরমা নদী খেয়া যোগে পার হয়ে হালুয়াঘাট থেকে অথবা শহরের বালুর মাঠ নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা যোগে হালুয়াঘাট থেকে রিক্সা অথবা টেম্পু যোগে ৫-৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি ডলুরা নামক স্থানে যেতে হয়।
ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি : সুনামগঞ্জ শহরের পাশে টিলা পরিবেষ্টিত এবং সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছাতকে অবস্থিত। বিশাল আয়তনের এ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যটকদের জন্য একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিবছর ছাতকে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যটকরা আসেন এই পুরাতন ঐতিহ্যবাহী এই সিমেন্দ ফ্যাক্টরি দেখতে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা হতে সরাসরি বাস যোগে ছাতক আসতে হবে। ছাতক আসলে যেকোনো সিএনজি বা অটোরিকশাকে বললেই হবে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কথা।
বারেকের টিলা : জেলা শহর সুনামগঞ্জ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নান্দনিক সৌন্দর্যে ঘেরা বারেক টিলা ভ্রমণে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ভ্রমণ পিপাসুদের নৌ-বিহারে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে যাদুকাটার বুক। দর্শনার্থীদের কেউ মায়ার নদী কেউবা রুপের নদী বলে অভিহিত করেন এই নদীকে। বর্ষায় পাহাড়ি নদী যাদুকাটার বহমান স্রোতধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ভিড় জমায় পর্যটকরা। এছাড়া যাদুকাটা নদী থেকে হাত রাখলেই ছোঁয়া যায় সবুজে ঘেরা বারেক টিলা। বারেকটিলায় ঘুরে ঘুরে যাদুকাটা নদীর প্রকৃত রূপ উপভোগ করা সম্ভব। বারেক টিলায় আদিবাসীদের একটি গ্রাম রয়েছে। বারেকটিলার সবুজ বনায়ন ও চারপাশে নদী, পাহাড় ও হাওরের মনোরম দৃশ্যে মন হারিয়ে যাবে নিশ্চিত। যাদুকাটা নদীর তীরঘেঁষে পূর্ব-উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ আরেফিনের (রহ) আস্তানা।
যেভাবে যাবেন : প্রথমে আপনাকে ঢাকা থেকে আসতে হবে সুনামগঞ্জ। যার জন্য রাজধানী ঢাকায় শ্যামলী, মামুন বা এনা পেয়ে যাবেন। সুনামগঞ্জ এসে সুরমা নদীর ওপর আব্দুর জহুর সেতুতেই লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে মালিককে বারেকটিলা যাওয়ার কথা বললেই নিয়ে যাবে সেখানে।
শিমুল বাগান : সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর নিকটবর্তী মানিগাঁও গ্রামে ১০০ বিঘারও বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা এক শিমুল গাছের বাগান রয়েছে। ২০০৩ সালের ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে তিন হাজার শিমুল গাছ লাগানোর মাধ্যমে জয়নাল আবেদীন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী এই বাগান শুরু করেন। শিমুল গাছের পাশাপাশি এই বাগানে অনেক লেবু গাছও রয়েছে। বসন্তকালে শিমুল বাগানের দিকে তাকালে গাছের ডালে ডালে লেগে থাকা লাল আগুনের ঝলকানি চোখে এসে লাগে। শিমুল ফুলের রক্ত লাল পাপড়িগুলো এই সৌন্দর্য এখানে আসা সমস্ত মানুষের মনকেই রাঙিয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমানে ফলগুলো না থাকলেও গাছের সাড়ি সাড়ি সবুজ পাতা মনকে ভালো রাখতে পারবে শতভাগ।
যেভাবে যাবেন : ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহণের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহণের বাস। সুনামগঞ্জ থেকে সিএনজি কিংবা মোটরসাইকেল ভাড়া করে সরাসরি বারেকের টিলায় আসতে হবে। বারেকের টিলা থেকে নেমে পাশে কিছু চায়ের দোকান পাবেন এখানে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই শিমুল বাগান দেখিয়ে দেবে। চাইলে সরাসরি মোটরসাইকেল নিয়েই যেতে পারবেন শিমুল বাগানে।
মোসাইদ রাহাত/এমএসএইচ/এমএস