নুসরাত বলেছিল শেষ দেখে ছাড়ব
মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় তার বাবা একেএম মুসা, চাচাতো ভাই মুহাম্মদ আলী ও মামা সৈয়দ সেলিমের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
সোমবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে উপস্থিত হয়ে তারা সাক্ষ্য দেন।
জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাফেজ আহাম্মদ বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় ৯২ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত বাদীসহ ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ, প্রদীপ বিশ্বাস, জান্নাতুল ফেরদৌস, আবু তাহের, আরমান বিন আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ ওবায়দুল ইসলাম, এ কে এম মনিরুজ্জামান এবং অর্চনা পালসহ জেষ্ঠ্য বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের সাক্ষ্য দেবার কথা রয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, সোমবার সাক্ষ্য দেয়ার সময় নুসরাতের বাবা একেএম মুসা জানান, ‘গত ২৭ মার্চ আমি কর্মস্থলে ছিলাম। আমার স্ত্রী মোবাইল ফোনে জানায়, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা দফতরি নুরুল আমিনকে দিয়ে আমার মেয়ে নুসরাতকে তার রুমে ঢেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। খবর পেয়ে পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে থানায় নিয়ে আসে। ওইদিন আমার স্ত্রী মামলা দিলে পুলিশ তাকে আটক করে। পরে শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের ও আফসার উদ্দিন মামলা তুলে নিতে আমার ছেলেদের হুমকি দেয়।
তিনি বলেন, ২ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হলে আমার বড় ছেলে নুসরাতকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যেত এবং পরীক্ষা শেষে নিয়ে আসত। অধ্যক্ষ আটকের পর তার অনুসারী কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন করলে আমার মেয়ে মানসিক কষ্ট পায়। তারা খারাপ লোকের শাস্তি দাবি না করে উল্টো মুক্তি চাওয়ায় ন্যায় বিচার পাবে কি না চিন্তায় পড়ে যায়। তারপরও নুসরাত শেষ দেখে ছাড়বে বলে আমাদের বলতো।
তিনি আরও বলেন, ৬ এপ্রিল নুসরাতকে নিয়ে আমার বড় ছেলে নোমান পরীক্ষার হলে গেলে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু এর আগে দুটি পরীক্ষায় অসুস্থতার কারণে সে নুসরাতকে হলে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল। ওইদিন আমার স্ত্রী ফোন করে জানায়, কে বা কারা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে। আমার স্ত্রীসহ দুই ছেলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক আমি কর্মস্থাল থেকে বাড়ি এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যাই।
একেএম মুসা বলেন, ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে প্রথম দুই দিন কথা বলতে পারতো। কীভাবে তার গায়ে আগুন দেয়া হয়েছে সে আমাদের বলে গেছে। সে বলেছে, পরীক্ষা দিতে হলে প্রবেশ করলে অধ্যক্ষের ভাগ্নিনি তুহিন তাকে জানায় সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিশাতকে কারা যেন মারছে। এটা শুনে ছাদে গিয়ে বোরকা, হাতমোজা ও চশমা পড়া চারজনকে দেখতে পায়। একজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। সে রাজি না হওয়ায় একজন তার মুখ চেপে ধরে হাত-পা বেঁধে ফেলে। অপর একজন তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের গলার স্বর চেনা লাগলেও পুরোপুরি চিনতে পারেনি। তবে তারা একজনকে শম্পা বা চম্পা বলে ডাক দেয় বলে জানিয়েছিল নুসরাত। পরে ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে মারা যায়। পরদিন হাসপাতালের মর্গে তার সুরতহাল রিপোর্ট হলে তাতে সাক্ষর দিয়ে তাকে নিয়ে আসি। ১১ এপ্রিল সোনাগাজীর সাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করি। আমি নিজেই মেয়ের জানাজা পড়াই।’ তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
এ সময় মামলার বাদী ও নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান এবং ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান তার সঙ্গে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
নুসরাতের চাচাতো ভাই মুহাম্মদ আলী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘গত ৬ এপ্রিল ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে আমার বড় ভাই ওমর ফারুক ফোন দিয়ে জানান, নুসরাতের গায়ে কে বা কারা আগুন দিয়েছে। আমি দ্রুত হাসপাতালের গেটে গিয়ে জানতে পারি তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আমি, নোমান, রায়হান ও আমার চাচিসহ তাকে ঢাকায় নিয়ে যাই। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। আমরা কুমিল্লা পৌঁছালে জানতে পারি নুসরাত মারা গেছে। ওইদিন রাতে তার মরদেহ হিমাগারে রাখা হয়। পরদিন সুরতহাল রিপোর্টের জন্য একটি নথি নিয়ে শাহাবাগ থানায় যাই। সে কাগজ হাসপাতালের কর্মকর্তাদের দিলে তারা মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। আমি তাতে স্বাক্ষর করি।’
নুসরাতের দূর সম্পর্কের মামা সৈয়দ আলম বলেন, ‘গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা আটকের পর অনুগত শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিনসহ আরও অনেকে তার মুক্তির জন্য মানববন্ধন করেন। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম মাদরাসায় এসে অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য শিক্ষার্থীদের যা করার দরকার তা করতে বলেন। পরে ৬ এপ্রিল অধ্যক্ষের নির্দেশে নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম, জাবেদ, যোবায়ের, কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপিসহ সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা চালায়। পরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আমি তার চিকিৎসার কাজে সহায়তা করি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে তার মৃত্যু হয়। পরদিন পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। আমি সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করি।’
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। টানা পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনের সর্বেচ্চ শাস্তি দাবি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এ মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রাশেদুল হাসান/এমএমজেড/জেআইএম