অনিয়মের কারণে নিয়োগ স্থগিত
নানা অনিয়মে জর্জরিত ফরিদপুর ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা সেবা প্রদানে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের।
এদিকে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও নার্সিং ইন্সটিটিউটের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগে চাকরি প্রার্থীদের ক্ষোভের মুখে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করেতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, ২৭টি পদের বিপরীতে বিতর্কিত পন্থায় এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। গত শুক্রবার ওয়ার্ডবয় (পুরুষ) ও আয়া (মহিলা) এই দুই পদের লিখিত পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার ক্লিনার পদে মৌখিক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত দুই পদের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল ও শনিবারের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ মে ২৭টি পদের বিপরীতে জনবল নিয়োগের জন্য দুটি পত্রিকায় অসম্পূর্ণ বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কোন পদে কতজন নিয়োগ হবে বিজ্ঞাপনে বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ ছিল না। ফলে চাকরি প্রার্থীরা আবেদন করতে বিপাকে পরেন। এক ধরনের ধুম্রজালের মধ্যেই চলছিল এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্নের পাঁয়তারা।
ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. মজিবুর রহমান জানান, গত ২২ মের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে আগ্রহীদের আবেদন করতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ৩ হাজার ৩২৮টি ফরম বিক্রি হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন জমা দেন ২ হাজার ৬৭৯ জন। তবে যাচাই বাছাইয়ে এর মধ্যে ৫১৩ জন বাদ পড়ে যায়।
একাধিক আবেদনকারী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অভিযোগ করেন, ‘বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের শুরু থেকেই অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা অবলম্বন করা হয়। এজন্য আমাদের হিমশিম খেতে হয়। তা সত্ত্বেও আবেদন করার পর অনেকের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। আমরা স্পষ্টত বুঝতে পারছি তারা পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতেই এসব অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছেন।’
অভিযোগ রয়েছে, বিশাল জনবল নির্ভর ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বরাবরই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। সমিতির নেতৃবৃন্দ নিজেরাই কমিটি গঠন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তবে এবারই এর বাইরে একমাত্র বহিরাগত প্রতিনিধি হিসেবে রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোশাররফ আলীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, বিশাল এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে ডায়াবেটিক সমিতির নেতারা অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা চালান। তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তথ্য গোপন রেখে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই তৎপর ছিলেন। ইতিপূর্বেও তারা ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা অবলম্বন করে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেলা শহর ফরিদপুরে প্রতিষ্ঠিত এই ডায়াবেটিক সমিতি বর্তমানে বিশালাকৃতির প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সমিতির অধীনে একটি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট ছাড়াও রয়েছে ফরিদপুর হার্ট ফাউন্ডেশন নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। তবে সিংহভাগ রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, এসব হাসপাতালের ওপর বৃহত্তর ফরিদপুরবাসীর ব্যাপক নির্ভরতা থাকলেও কর্তৃপক্ষের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষ পূরণে সচেষ্ট নন। হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায় করা হয়। বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়।
এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা বিভিন্ন সময়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অসহযোগিতার নানা অভিযোগ করছেন। কিন্তু সেগুলো সুরাহার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কখনোই সচেষ্ট নন।
এদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে বিগত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে চাকরি করলেও অনেকেরই বেতন বাড়েনি। অথচ মাত্র দুইবছর চাকরি করছেন এমন কর্মচারীর বেতন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হয়েছে। আবার কর্মচারীদের ওভারটাইমের বিল দেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী নিয়ম। কতিপয় কর্মচারী কাজ না করেও ওভারটাইওমের নামে বিল তুলে নিচ্ছেন।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বিশালাকৃতির এ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যেসব জিনিসপত্র কেনা হয় সেখানে কখনোই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় না। মালামাল ক্রয় ও সংস্কার কাজে দরপত্র আহ্বানের নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি কখনই তা করে না। নিজেদের পছন্দের লোকদের দিয়ে কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
সূত্র জানায়, কয়েক মাসে আগে চারটি লিফট ক্রয় করা হয়। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। আবার ওই লিফটগুলো কোনো ধরনের সার্ভিসিং না করেই প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের বিল ভাউচার করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারি নানা উৎস থেকে অনুদান ও সহায়তা প্রদান করা হয় ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। এসব টাকা খরচে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এতোবড় একটি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট কখনোই স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়নি। দুর্নীতির তথ্য গোপন করে দায়সারা অডিট রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে।
হাসপাতালে দরিদ্র ও সামর্থ্যহীন রোগীদের জন্য অনুদান ও সহায়তা হিসেবে আসা ওষুধ সামর্থ্যবানেরা লুটপাট করছে। ডায়াবেটিক মেডিকেল কলেজে ছাত্র ভর্তি নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানাভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে কব্জা করে অবৈধ সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে চিকিৎসাসেবা প্রদানে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ আবদুস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অনিবার্যকারণে শনিবার এক জরুরি সভায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নানা অনিয়মের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বরাবরই এভাবেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি বড় হয়ে যাবে বিধায় শূন্য পদে কতজন নিয়োগ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়নি।
তিনি বলেন, আগামীতে পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে। কোথাও অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব। এখন বয়সের চাপে হাসপাতালের ভার বহন করতে পারছেন না বলেও স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোশার্রফ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ মোশাররফ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষকদের দ্বারা উপ-কমিটি গঠন করে নতুন করে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। শিগগিরই কলেজ থেকে আবেদন ফরম বিতরণ ও পরীক্ষা সম্পন্নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বি কে সিকদার সজল/এমএমজেড/পিআর