ছেলেধরা সন্দেহে নিহত রেনুর আমেরিকা যাওয়া হলো না
মেয়েকে ভর্তির জন্য স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনু (৪০) আগামী জানুয়ারি মাসে আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে তার একমাত্র ভাই আলী আজগর ২৩ বছর ধরে বসবাস করছেন।
আমেরিকা যেতে রেনু সব প্রস্তুতি গুছিয়ে নিয়েছেন। মারা যাওয়ার দিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি ফটোকপি করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে বের হন। ওই দিন ছোট মেয়েকে খালার কাছে রেখে যান।
রোববার বেলা ২টার দিকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর সোনাপুর গ্রামে এসব কথা বলেন নিহত রেনুর ভাগনি নূরজাহান বেগম মুন্নি। এ সময় পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান তিনি।
গতকাল শনিবার (২০ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাসলিমা বেগম রেনুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মেয়েকে ভর্তির জন্য ওই স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়ে কথাবার্তায় সন্দেহ হলে মুহূর্তের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে পিটুনি দিলে তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন : গণপিটুনিতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে
রেনুকে হত্যার জন্য পরিবারের সদস্যরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ বেগম ও অফিস সহকারী জান্নাতুল ফেরদাউসকে দায়ী করেছেন।
তারা বলছেন, প্রধান শিক্ষক ইচ্ছা করলে রেনুকে বাঁচাতে পারতেন। যখন ছেলেধরা বলে স্কুলের ভেতরে গুজব ছড়াচ্ছিল, তখন রেনুকে রুমে বসিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যেত। তাহলে আর নির্মম পিটুনির বলি হয়ে রেনু মারা যেত না। এজন্য প্রধান শিক্ষক ও অফিস সহকারীকে গ্রেফতারের দাবি জানান রেনুর পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে মেয়ের মৃত্যুর কথা শুনে বৃদ্ধ মা ছবুরা খাতুন অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। তিনি ঢাকায় ওই মেয়ের বাসায় থাকতেন। দুই বছর আগে স্বামীহারা হয়েছেন তিনি। এখন আদরের ছোট মেয়ে নির্মমভাবে চলে যাওয়ার খবর তাকে নিয়ে এসেছে মৃত্যুর দুয়ারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাসলিমা বেগম রেনুর এক ভাই ও পাঁচ বোন। মাস্টার্স শেষ করা রেনু সবার ছোট। পড়ালেখা শেষে তিনি ঢাকায় আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেছিলেন। গত দুই বছর তিনি প্রাইভেট পড়াতেন। পারিবারিক কলহের কারণে প্রায় দুই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে রেনুর ডিভোর্স হয়। তাদের সংসারে তাসফিক আল মাহি (১১) ও তাসলিমা তুবা (৪) নামের দুই সন্তান রয়েছে। বিচ্ছেদের পর ছেলে বাবার সঙ্গে থাকে। আর মেয়ে মায়ের কাছে থাকতো।
লক্ষ্মীপুর শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে নিহত রেনুর গ্রামের বাড়ি। দুপুরে সবুজ প্রকৃতিতে ঘেরা গ্রামের ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, পারিবারিক করবস্থানে মাটি খুঁড়ে করব করার কাজ চলছে। দুই বছর আগে মারা যাওয়া বাবার কবরের পশ্চিম পাশে তাকে শায়িত করা হবে। ঘরের ভেতর পরিবারের সদস্যরা কাঁদছেন। তাদের চোখে-মুখে স্বজন হারানোর চাপ। রেনুর অবুঝ মেয়েটিও কান্নাকাটি করছে, কিছুতেই কান্না থামছে না তা। আশপাশে মানুষের উপস্থিতি যেন তার কাছে অজানা ভয়। শিশুটি নিরিবিলি আশ্রয় খুঁজছে। আশপাশের গ্রামের লোকজন নিহত বাড়িতে এসে সমবেদনা জানাচ্ছেন।
সেখানে কথা হয় রায়পুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তারেক আজিজ জনির সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। গুজব ছড়ানো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনলে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পাবে না।
নিহতের চাচাতে ভাই মোক্তার হোসেন বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি চক্র গুজব ছড়াচ্ছে। আর এর বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আমার বোনরা। বিবেক শক্তি লোপ পেয়ে আমরা দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
নিহতের ভগ্নিপতি অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী মো. বদিউজ্জামান বলেন, অভিভাবকরা সন্তান ভর্তি করার জন্য স্কুলে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে গুজব ছড়িয়ে একজন শিক্ষিত-সংগ্রামী নারীকে এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করতে হবে। এ সভ্য সমাজে এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের গ্রেফতারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাচ্ছি। যেন আর কোনো নারী এভাবে গুজবের বলি না হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রায়পুরের সোনাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউছুফ জালাল কিসমত বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। গুজব এড়াতে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
কাজল কায়েস/এএম/পিআর