নুসরাত হত্যা : অনেক ঘটনা ধামাচাপা দিতেন রুহুল-মাকসুদ
ফেনীর আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আজও চারজনের সাক্ষগ্রহণ ও জেরা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার বাংলা বিভাগের প্রভাষক খুজিস্তা খানম, আয়া বেবি রানি দাস, আলিম পরীক্ষার্থী আকলিমা আক্তার ও কায়সার মাহমুদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট হাফেজ আহাম্মদ বলেন, মঙ্গলবার আদালত মামলাটির ২২ নম্বর থেকে ২৫ নম্বর পর্যন্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। বৃহস্পতিবার মামলার আরও তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। এরা হলেন- আলিম পরিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তার হামদুনা, নাসরিন সুলতানা ও শিক্ষক মোহাম্মদ কবির আহাম্মদ। এরা মামলাটির ২৬ থেকে ২৮ নম্বর সাক্ষী বলে জানান তিনি।
আদালত সূত জানায়, আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে প্রভাষক খুজিস্তা খানম বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ সাইক্লোন শেল্টারের তিন তলায় নিজের অফিস স্থানান্তরের পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেন। এটা মাদরাসার অনেকেই জানতেন। তবে কেউ প্রতিবাদ করেননি। মাঝে মাঝে আমি প্রতিবাদ করতাম। তখন সিরাজ উদ দৌলা আমাকে হেনস্তা করতেন।
খুজিস্তা বলেন, এ ধরনের ঘটনাগুলোতে রুহুল আমিন, মাকসুদ আলম সব সময় সিরাজের পক্ষ নিতেন এবং ধামাচাপা দিতেন।
তিনি নুসরাতের সহপাঠী ফুর্তির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, গত বছর ফুর্তিকে সিরাজ যৌন হয়রানির চেষ্টা করলে তারা প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনও রুহুল-মকসুদ এক হয়ে সিরাজের পক্ষ নিয়ে তা ধামাচাপা দেন।
সহপাঠী কাওসার আদালতকে বলেন, সেদিন পরীক্ষার হলে জাবেদ পরীক্ষা শুরু হবার একটু আগে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে এবং পরীক্ষায় অংশ নেয়।
আয়া বেবি রানি ৬ এপ্রিলের ঘটনা বর্ননা দিয়ে বলেন, সেদিন দেহ ঢেকে দিতে ওড়না সংগ্রহ করে এগিয়ে দিই এবং পোড়া দেহে পানি এনে ঢেলে দিই।
আরেক সহপাঠী আকলিমা আদালতকে বলেন, ৬ এপ্রিল আমি ৯টা ৪০ মিনিটে ৯ নম্বর কক্ষে পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ৯টা ৪৫ মিনিটে স্যার খাতা দিয়েছেন। আমরা বৃত্ত ভরাট করছিলাম। ১০টা বাজার একটু আগে উম্মে সুলতানা পপি ব্যস্ত ভঙ্গিতে হলে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর বাইরে ‘আগুন’ ‘আগুন’ বলে চিৎকার শুরু হলে আমরা সবাই বাইরে যাই। কিন্তু পপি বের হয়নি। সে হলেই বসা ছিল। আরও কিছুক্ষণ পর পপি বলে, নুসরাত নিজেই তার শরীরে আগুন দিয়েছে। এরপর পপি যথারীতি পরীক্ষা দেয়।
মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু, কামরুল হাসান, ফরিদ উদ্দিন নয়ন ও আহসান কবির বেঙ্গল সাক্ষীদের জেরা করেন। রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষে ছিলেন পিপি হাফেজ আহাম্মদ, এপিপি এ কে এস ফরিদ আহাম্মদ হাজারী ও এম শাহজাহান সাজু। বুধবার শুনানিকালে মামলার ১৬ আসামি আদালতে হাজির ছিলেন।
নুসরাত হত্যা মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীমের (২০) সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে চার্জশিট প্রদান করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এ মামলায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফেনী সদর হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। সেখানে ১০ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে নুসরাত মারা যান।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।
রাশেদুল হাসান/আরএআর/এমএস