‘পানিতে বাচ্চা-খাচ্চা নিয়া থাকার ক্ষমতা নাই’
‘আমরার ঘর দোয়ার একবারে পানির তলে, আমরা বেশি অসহায়। আমরা কাম করতাম পারলে খাই আর না করতে পারলে উপাস থাকন লাগে। আজকে পানির আগ থকি কাম নাই কাজ নাই আইছে পানি, ঘরে বাচ্চা-খাচ্চা নিয়া থাকার ক্ষমতা নাই। ঘরের ভিতরে সাপ সবায় ডরায়। আমরারে চেয়ারম্যান সাবে জায়গা দিসোইন। তাইন আমরারে চিড়া গুড় চাউল দিসোইন আমরা খাইতেছি। আমরা যে আছি ঘরের পানি এখনো শুকাইছে না, ঘরের পানি শুকাইলে গেলামগি নে। আমরা চলতাম কিলা খাইতাম কিলা কেউ যদি সাহায্য সহযোগিতা করোইন তাইলে বাছতাম নাইলে বাছতে পারতাম না।’
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রাধানগর গ্রামের মহিরুন নেছা এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশাসন থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা পাচ্ছেন না অনেকেই।
সরেজমিনে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রাধানগর, লালপুর, কুতুবপুর ও বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখনো পানির নিচে বসবাস করছেন অনেকে। রাধানগর ও লালপুর এলাকার ২০ পরিবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় একটি দোকান-কোটায় আশ্রয় দিলেও গুড় চিড়া ও পাঁচ কেজি চাল দিয়ে চলছে তাদের বর্তমান জীবন। তাছাড়া এখনো অনেক পরিবার রয়ে গেছে পানির নিচে। মায়ার ভিটা ছেড়ে আসতে চাইছেন না তারা। মাঝে মধ্যে মসজিদের টিউবওয়েল থেকে পানি পান করলেও বেশিরভাগ মানুষ হাওর থেকেই পানি তুলে খাচ্ছেন। প্রত্যেককে দুটি করে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হলেও তা প্রথমদিনই শেষ হয়ে যায়।
রাধানগর এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাবিনা খাতুন বলেন, আমরার বাড়ির মাঝে কমর পানি। আমরা অসহায়। বাচ্চা খাচ্চা নিয়া খুব অসহায়ের মধ্যে আছি। আমরার কাজ করার সুযোগ নাই। এখন কেউ যদি দয়া করে তাইলে খাইয়া তাইক্কা বাঁচতাম।
পা ভেঙে পরিবারের ভরণপোষণ করাতে পারছেন না রিকশাচালক লোকমান হোসেন। তিনিও এসেছেন দোকান-কোটায় আশ্রয় নিতে। তিনি বলেন, আমি চারমাস ধরে বিছানায়। আমার রোজগার নাই। আমার উপরই সংসার চলে। ঘরে পানি আইছে দেখিয়া এখন এই জায়গায় আইয়া বইয়া রইছি। রিকশা চালাইয়া যে পরিবারের দেখভাল করতাম তার কোনো সুযোগ নাই।
কুতুবপুর এলাকার বাসিন্দা মৎসজীবী বাবুল আহমেদ বলেন, আমরা খুব অসহায়। ঘর পানির তলে। এখন মেম্বার-চেয়ারম্যান দিলে আমরা খাই নাইলে উপাস থাকি। এই বন্যায় আমার ঘরের বাসনপত্র থেকে শুরু করে দুইটা ছাগলসহ সবকিছু পানির তলে তলিয়ে গেছে। মহাজনের কাছ থাকি জায়গা আনিয়া কিছু ধান চাষাবাদ করছিলাম তাও নিছেগি বন্যায়।
বিসিক এলাকার আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরার ঘর পানির তলে। বাজারো যাইতে হইলে ভেলা বা নৌকায় আশ্রয় নেয়া লাগে। মানুষের সঙ্গে গরুও ক্ষতিগ্রস্ত। নিজে যেমন তেমন চলি কিন্তু অসহায় প্রাণী নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এখন পর্যন্ত কোনো চেয়ারম্যান-মেম্বার আইয়া আমরারে দেখছে না, সাহায্যতো দূরের কথা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌররাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন, সরকার যে ত্রাণ দিচ্ছে তা খুব কম। সবাইকে ঠিকমতো দিতে পারি না। আমারা এই গৌরারং ইউনিয়ন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। তাই আমি চাইবো ত্রাণের মাত্রাটা যেনো বাড়িয়ে দেয়া হয়।
এদিকে বন্যায় সুনামগঞ্জের সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, ধর্মপাশা উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১১টি উপজেলার মধ্যে মাত্র ২২টি আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ উঠলেও বেশিরভাগ মানুষ রয়ে গেছেন পানির সঙ্গেই
সুনামগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জে বন্যায় আমরা ৭ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। সঙ্গে চাল ও নগদ অর্থও দিয়েছি। আমাদের কাছে বর্তমানে শুকনা খাবার নেই। আমরা চিঠি পাঠিয়েছি, খুব শিগগিরই শুকনো খাবার পেয়ে যাবো।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা বিকল্প উপায়ে শুকনো খাবার দিচ্ছি। জিআরের ক্যাশের টাকায় শুকনো খাবার ক্রয় করে বন্যার্তদের মধ্যে দেয়া হচ্ছে। কারণ এখন চাল আর টাকার চেয়ে শুকনো খাবার খুব প্রয়োজন। যদি টানা বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে বন্যা পরিস্থিতি থেকে আমরা খুব দ্রুত উঠে আসতে পারবো।
মোসাইদ রাহাত/আরএআর/পিআর