মির্জাপুরে নদী ভাঙনে গৃহহীন অর্ধশত পরিবার
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বংশাই ও ঝিনাই নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে উপজেলার ফতেপুর ও ভাতগ্রাম ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের অর্ধশত ঘরবাড়িসহ ও কয়েকশ একর আবাদি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে।
এছাড়া উপজেলা সদরের সঙ্গে ফতেপুর ইউনিয়নের যোগাযোগের প্রধান সড়ক কুর্ণী-ফতেপুর সড়কে একটি কালভার্টসহ প্রায় ৪০০ ফুট রাস্তা নদী গর্ভে চলে গেছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এলাকাবাসী। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে থলপাড়া গ্রামের আশরাফুল উলুম হাফিজিয়া মাদরাসাও।
ভাঙনের কবল থেকে ঘর-বাড়ি রক্ষা করতে অনেকেই নদীর কিনারায় বাঁশের বেড়া দিয়ে ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা করছেন।
এলাকাবাসীরা জানান, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে বংশাই ও ঝিনাই নদীর পানি বৃদ্ধি শুরু হয়। এতে ফতেপুর ইউনিয়নের থলপাড়া, ফতেপুর, বানকাটা, চাকলেশ্বর, বৈলানপুর-পাতিলাপাড়া ও ভাতগ্রাম ইউনিয়নের গোড়াইল এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের তীব্রতায় এরই মধ্যে রাস্তা, ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। ণে বানকাটা ও গোড়াইল গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অনেকেই বসত বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। হিলরা বাজারের উত্তর পাশের অধিকাংশ স্থান এবং বাজারের পার্শ্ববর্তী এলজিইডির রাস্তা- কালভার্ট ভেঙে গেছে। বিলীন হয়েছে শত শত একর আবাদি জমি।
পানি বাড়ার পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে নদীর ওইসব এলাকা থেকে খননযন্ত্র দিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা বালু তুলছেন। এ কারণে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
গত রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কুর্ণী-ফতেপুর সড়কে আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করতো ভাঙনের ফলে এখন প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ট্রাক- সব ধরনের মোটর গাড়ির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী আবাদী জমির ওপর দিয়ে সীমিতভাবে শুধুমাত্র স্থানীয়দের মোটরসাইকেল, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান চলাচল করছে।
সিএনজি অটোরিকশা চালক আব্দুল হক মিয়া জানান, ভাঙনের ফলে আগে যেখানে প্রায় ৩০০ সিএনজি চলতো এখন সেখানে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মাত্র ৬০-৭০টি চলছে।
হেলাল মিয়া, আজিম মিয়া নামে বানকাটা গ্রামের দুই বাসিন্দা বলেন, এলাকার আক্তার হোসেন, সাইজ উদ্দিন, কদ্দুছ, নুরু, পলাশ, প্রিন্স, আওয়াল ও সজল প্রতি বছর ড্রেজার মেশিন দিয়ে ঝিনাই নদীর প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন স্থানে বালু উত্তোলন করে থাকে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে খননযন্ত্র দিয়ে ঝিনাই নদী থেকে বালু উত্তোলন করায় ফলে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যাদের বাড়ি ও আবাদি জমি নদী ভাঙনের কবলে পড়েছেন তারা এতই দরিদ্র যে অন্যত্র বাড়ি বানানোর অবস্থাও নেই। অনেকেই ঘর-বাড়ি রক্ষা করতে নদীর কিনারায় বাঁশের বেড়া দিয়ে ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা করছেন।
নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বানকাটা গ্রামের সায়েদ আলী, আয়নাল মিয়া, মালেকা বেগম, ফিরোজা বেগম, কাঞ্চন বালা ও গোড়াইল গ্রামের জয়নাল মিয়া জানান, তাদের বসত বাড়ি ও আবাদি জমি বংশাই ও ঝিনাই নদীতে চলে গেছে। তাছাড়া বানকাটা গ্রামের বেলায়েত হোসেন, আবুল হোসেন, মুগদম আলী, লাল মোহন, পলান ও দলু মিয়ার ঘরবাড়িসহ প্রায় ৫ একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হারুন অর রশিদ খান জানান, পাতিলাপাড়া-বৈলানপুর এলাকার পানি নদীতে ফেলতে প্রায় ৫ বছর আগে পাইপ স্থাপন করা হয়েছিল। আর চার বছর আগে রাস্তা সংস্কারের সময় ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কী কারণে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল তা বোধগম্য নয়। পাইপের মাথায় কালভার্ট থাকাতে পানি চুইয়ে নদীতে পড়ে। এতে কালভার্টের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে থাকে।
তিনি বলেন, এলাকার প্রভাবশালীরা ড্রেজার দিয়ে নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে বালু তোলেন। ফলে হিলরা বাজারের উত্তর পাশসহ, কালভার্ট, সড়ক, ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি ভেঙে যাচ্ছে।
থলপাড়া গ্রামের ঠিকাদার জাহিদ মিয়া, বারেক মিয়া ও ফতেপুর বাজারের ব্যবসায়ী জুয়েল বলেন, বানকাটা এলাকা থেকে চাকলেশ্বর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা প্রতিবছরই নদী ভাঙনের শিকার হয়। কিন্তু ভাঙন রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পাশাপাশি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকারিভাবে জমি বরাদ্ধ দিয়ে বাড়ি বানানোর সুযোগ দেয়ার দাবি জানান তারা।
চাকলেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা হাবেল মৃধা, ফরিদ মিয়া গোড়াইল গ্রামের জয়নাল জানান, ভাঙনের কারণে তাদের যাতায়াতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। আবাদি জমি ও বাড়ি নদীতে যাচ্ছে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ দরকার।
আশরাফুল উলুম হাফিজিয়া মাদরাসার পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ও সম্পাদক আব্দুর রউফ জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে দেড় শতাধিক ছাত্র রয়েছে। কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ঢলে ঝিনাই নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে মাদরাসাটি হুমকির মুখে পড়েছে।
মির্জাপুর উপজেলা এলজিইডির উপ-সহকারি প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাইবো) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এস এম এরশাদ/এমএমজেড/পিআর