কঠোর পরিশ্রমেও ঘোচেনি তাদের কষ্ট
‘পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ। আলস্যে দারিদ্রতা আনে, পাপে আনে দুঃখ’। একজন মানুষকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় এই খনার বচনটি নানাভাবে অর্থবহন করলেও বাস্তবে কিছু ঘটনার সঙ্গে রয়েছে অনেক অমিল।
নানা পেশার ভিড়ে কাঠ বহনকারী শ্রমিকরা যুগের পর যুগ ধরে তিল তিল করে নিজের জীবনটাই শ্রমের মাধ্যমে বিকিয়ে দিয়েও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি। আজীবন দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করেই তারা এখন প্রায় পৌঁছে গেছেন জীবনের শেষাংশে। কঠোর পরিশ্রম তাদের সুখ এনে দিতে পারেনি।
গাজীপুরের শ্রীপুরে শীতলক্ষ্যা ঘেঁষা বরমী বাজারে এমন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা চালানো শ্রমিকদের মুখে এখন শুধুই জীবনে না পাওয়ার বেদনার গান। চেহারায় মলিনতা, কঙ্কালসার দেহের এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। কঠোর পরিশ্রমকে পুঁজি করে বিশালাকার বৃক্ষের ভার বহন করলেও জীবনের ভার বহন করা দিন দিন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে তাদের জন্য।
স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীরা জানান, কিশোরগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার অধিকাংশ কাঠব্যবসা শীতলক্ষ্যা নদীকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই নদীর তীর ঘেঁষা বরমীবাজার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
সেই সময়ই বাজারের একটি অংশ নিয়ে গড়ে ওঠে কাঠ মহল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নৌকা যোগে আসা গাছের বড় বড় খণ্ড শ্রমিকরা নৌকা থেকে নামিয়ে স্থানীয় স’ মিলগুলোতে নিয়ে যান। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ এই কাজে শ্রম বিক্রি করেন।
বরমী বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম ইজদান জানান, কাঠ শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন। তারা নদী থেকে কাঠ কাঁধে করে ডাঙ্গায় তুলে, আবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কাঁধে করে পরিবহন করে থাকে। বর্তমান সভ্যতায় নানা জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার হলেও এই পেশায় নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। এখানে শুধু কায়িক শ্রমকেই ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার পর বরমী বাজারে ৬০ জন শ্রমিক এ পেশায় নিয়োজিত থাকলেও পরিশ্রমের কাছে পরাজিত হয়ে অনেকেই বিদায় নিয়েছেন। বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১২ জন।
নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামের জমিস উদ্দিন জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন কাঁধে ভার বহন করে। তাই কাঁধের একটি অংশ পশুর ঘাড়ের মত হয়ে গেছে তার। নিজের ওজন ৫৫ কেজি থাকার পরও তাকে বহন করতে হয় শত কেজির বেশি ভার। কাজ থাকলে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে মাইনে মেলে ২শ থেকে ৩শ টাকা, আর কাজ না থাকলে শূণ্য হাতেই বাড়ি ফেরেন।
হরতকি গ্রামের আব্দুল খালেক বয়সের ভারে নুহ্য হয়ে পড়ছেন, তবে এখনও তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কেননা এ কাজ না করলে তার যে চুলা জ্বলে না। সম্পদ বলতে আছে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া মাত্র দেড় শতক জমি। দুই ছেলে মেয়ে রয়েছে অভাবের কারণে তাদেরও লেখাপড়া করাতে পারেননি।
সোহাদিয়া গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, আমাদের এ পেশার লোকেরা কঠোর পরিশ্রম করার পরও অভাব-অনটন মুক্ত হতে পারেনি। বিকল্প কোনো পথ খোলা না থাকায় তারা এখনও বেঁচে থাকার তাগিদে এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন রন। আমাদের দেখার যেন কেউ নেই।
বরমী বাজার বণিক সমিতির সভাপতি অহিদুল হক ভূঁইয়া জানান, এ যুগেও এ ধরনের কঠোর পরিশ্রম মানুষকে মানায় না। এ কাজ করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পরে। তারপরও তারা জীবিকা চালাতে এ ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। তাদেরকে যদি সহায়তা দেয়া যায় তাহলে হয়ত জীবনের শেষাংশে একটু আলো দেখতে পারে।
বরমী ইউপি চেয়ারম্যান শামসুল হক বাদল সরকার জানান, যুগের পর যুগ ধরে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এরা জীবন ও জীবিকা চালালেও বর্তমানে তাদের অবস্থান শোচনীয়। তাদেরকে সরকারের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় আনা হলে হয়ত তারা কিছুটা উপকৃত হবে।
শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, দরিদ্র এই জীবন সংগ্রামী কাঠ শ্রমিকদের পাশে থাকার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। বরমীর দরিদ্র পরিবারের এই শ্রমিকদের সরকারের সামাজিক কর্মসূচীর আওতায় আনা হবে।
শিহাব খান/এমএমজেড/পিআর