অনিশ্চিত গন্তব্যে আনোয়ারের দুই শিশু সন্তান
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় অটো স্পিনিং মিলসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে রাসেল ও আনোয়ারের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে আনোয়ারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে শোকের মাতম। পারিবারিক কবরস্থানে চলছে আনোয়ারকে সমাহিত করার আয়োজন। বাড়ির এক পাশে মরদেহের গোসল সম্পন্ন করার আয়োজন চলছে। উঠানের এক কোণে ইটের তৈরি চুলায় ফুটানো হচ্ছে পানি। সন্তান হারানোর শোকে পাগলপ্রায় বাবা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছেন, কি যেন খুঁজছেন, হারানো জিনিস কার কাছে চাইবে, কোথায় গেলে পাবেন সেই হারানো বুকের ধন। কিন্তু গতকালও এমন চিত্র ছিল না আনোয়ারদের বাড়িতে। হঠাৎ বদলে গেছে চিত্র। যে ছেলেটি বাড়ি থেকে সুস্থ অবস্থায় বের হয়ে গেল তিনি আজ বাড়িতে এসেছে, তবে প্রাণহীন দেহে। বেলা যতই গড়াচ্ছে শোকার্ত প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়দের ভিড়ে শোক যে বেড়েই চলছে। স্বজনদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশও ভারী হয়ে উঠছে।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত ছয়জনের মধ্যে আনোয়ার হোসেনের (২৭)। বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ ধনুয়া গ্রামে। তার বাবার নাম জয়নাল আবেদীন। তিনি কারখানায় এসি প্লান্ট বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার সকালে জেনারেল শিফটে কাজে যান আনোয়ার। জোহরের নামাজ ও দুপুরের খাবারের জন্য বাইরে বের হন। বিরতি শেষ হওয়ার আগে কারখানায় ঢুকে পড়েন।
জানা যায়, দুপুর আড়াইটার দিকে কারখানায় লাগা আগুনে এসি প্ল্যান্ট বিভাগে আটকা পড়েন আনোয়ার হোসেন। হয়তো নিজের দুই শিশুসন্তানের মায়ায় নিজেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলেন তিনি। আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন টয়লেটের ভেতর। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বুধবার কারখানার টয়লেট থেকে আনোয়ারের মরদেহ বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা।
আনোয়ার হোসেন হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা এক যুবক। সহায়সম্পদ বলতে ছিল একটি টিনের ছাপড়া ঘর। তবে এতে তার কোনো ধরনের আক্ষেপ ছিল না। কারণ তার মতে নিজের সততাকে বড় সম্পদ বলে অভিহিত করতেন এমন অভিমত বাবা জয়নালের।
কারখানায় দায়িত্ব, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও প্রাত্যহিক ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সময় চলে যেত তার। আট-নয় বছর আগে পাশের গ্রামের কল্পনা আক্তারকে বিয়ে করেন। এরপরই সংসারজুড়ে আসে ছেলে সামিউল (৫) ও আবু সাঈদ (৩)। স্বল্প বেতনে চাকরি করেও অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা আনোয়ার সন্তানদের ভালোবাসার অভাব বুঝতেই দেননি। তিনি সবসময় আগলিয়ে রাখতেন তাদের। তাই বাবার লাশ বাড়িতে আনার পরও বাবাকে হারানোর বেদনা আঁচ পায়নি সন্তানরা। মশারির নিচে বাবা শুয়ে আছে জানতে পেরে বড় ছেলে সামিউলের আকুতি ছিল আমি বাবার কাছে যাব।
দুপুরে আনোয়ারের লাশ যখন বাড়িতে আনা হয় তখন চারপাশের প্রতিবেশীরা তাকে শেষবারের মতো দেখতে তার বাড়িতে আসেন। ভালো ব্যবহারের কারণে সবার কাছে আনোয়ারের বিশেষ একটা পরিচিতি ছিল। স্বামীর মৃত্যুর খবরে স্ত্রী কল্পনা আক্তারও বার বার বিলাপ করছিলেন। সন্তান হারানোর ব্যথা নিয়েই ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছেন মা-বাবা। অপর পাশে কাঁদছিলেন দুই ভাই ও বোন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে প্রতিবেশীদের চোখের কোণেও জমেছিল অশ্রুর ফোঁটা।
আনোয়ারের বাবা জয়নাল মিয়া জানান, আমার বয়স হয়েছে। এখন আমারই চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু তার আগেই সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হচ্ছে। আমাদের সহায়সম্বল বলে কিছুই নেই। পরিশ্রম ও আদর্শ ধরে রেখে আনোয়ার ভালোই চলছিল। হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবই শেষ হয়ে গেল। নিজেই এখন চলার শক্তি হারিয়েছেন, তিনি আর কতটুকুুই বা আনোয়ারের পরিবারকে দেখে রাখতে পারবেন। বাবা না থাকায় এখন অনেকটা অনিশ্চিত গন্তব্যে আনোয়ারের দুই শিশুসন্তান।
শিহাব খান/এমএএস/পিআর