ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

হাসপাতালের বিছানায় বিষণ্নতায় দিন কাটছে হাত হারানো ফিরোজের

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১১:৪৩ এএম, ৩০ জুন ২০১৯

মলিন মুখ, শরীরজুড়ে বিষণ্নতার ছাপ। স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে গেছে দুর্ঘটনায় ডান হাত হারানো ফিরোজ আহমেদের। সামনে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বিষণ্নতায় দিন কাটছে ফিরোজের। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরীর কাটাখালী এলাকায় বেপরোয়া বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে ডান হাতের কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার।

ফিরোজ রাজশাহী কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। তিনি বগুড়ার নন্দীগ্রাম পৌরসভার নামোইটগ্রাম মহল্লার মাহফুজুর রহমানের ছেলে। ফিরোজের মাস্টার্সের পরীক্ষা চলছে। দুটি পরীক্ষাও দিয়েছেন তিনি।

শুক্রবার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিতে নিজ জেলা বগুড়া গিয়েছিলেন। এরপর বাড়ি গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে ওই দিনই ফিরছিলেন রাজশাহীতে। রোববার তার মাস্টার্স পরীক্ষা। কিন্তু এই দুর্ঘটনা তার সবই কিছু কেড়ে নিয়েছে।

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফিরোজ। রাত ১০টার দিকে অস্ত্রোপচার শেষে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। রাত ২টার দিকে তার জ্ঞান ফেরে। শনিবার সকাল ৯টার দিকে তাকে হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নেয়া হয়।

ঘটনার পর বাসটি ফিরোজকে রাজশাহী নগরীর তালাইমারী পর্যন্ত নিয়ে আসে। সেখানেই অন্য যাত্রীদেরও নামিয়ে দেয় বাসটি। এরপর ইউটার্ন নিয়ে পালিয়ে যান চালক। ওই বাসেই ছিলেন ফিরোজের একজন সহপাঠী ও দূর সম্পর্কের এক নানা। তারা তাকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফিরোজ জানান, তার বাসের পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িটি বাস নাকি ট্রাক জানেন না। ওভারটেকিং নাকি ক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে তাও বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। তবে এই দুর্ঘটনায় দুই চালকের দোষেই ঘটেছে। তিনি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন।

তিনি আরও জানান, বগুড়ার নন্দীগ্রাম থেকে তিনি বাসে ওঠেন। পথে নাটোর পর্যন্ত বাসটি থেমে থেমে যাত্রী ওঠা-নামা করছিল। কিন্তু রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা সদর পার হওয়ার পর বেপরোয়া গতিতে বাস চালাতে শুরু করেন চালক। কাটাখালী পৌরসভার সামনে এসে দুর্ঘটনায় পড়ে বাসটি।

ফিরোজ জানান, তিনি বসেছিলেন বাসের একেবারে শেষের আসনে। বেপরোয়া গতির কারণে বসে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল তার। বাধ্য হয়ে ডান হাত দিয়ে সামনের আসন আঁকড়ে ছিলেন তিনি। তার হাত ভেতরেই ছিল। কিন্তু আচমকা ঝাঁকুনিতে হাতটি আলগা হয়ে জানালার বাইরে চলে যায়। তখনই বিকট শব্দে পাশের গাড়ির সঙ্গে বাসটি ধাক্কা খায়। এতে চাপা পড়ে তার ডান হাত কেটে পড়ে। হাত কেটে পড়ার পরও হাসপাতালে নেয়া পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল। তবে যে গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে তিনি হাত হারিয়েছেন সেটি চিনতে পারেননি।

তবে যে গাড়িতে তিনি আসছিলেন সেটির ইংরেজিতে নামের প্রথম দুই অক্ষর ‘এম, ও’ তার মনে আছে। এছাড়া গাড়িতে ওঠার সময় খেয়াল করেছিলেন, সামনের কাঁচ ফাটা। দরজার সঙ্গে যে জানালা থাকে তার একটিতে কোনো কাঁচ ছিল না। নন্দীগ্রাম থেকে বাসে ওঠার সময় সেখানকার চেইন মাস্টার জানিয়েছিলেন, বাসটি বগুড়া থেকে আসছিল।

তবে রাজশাহীর নওদাপাড়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের বগুড়া কাউন্টারে গিয়ে জানা গেছে, বেলা ১১টার পর রংপুরের কোনো গাড়ি রাজশাহী আসে না। কিন্তু বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত রংপুর থেকে রাজশাহীর মালিকদের গাড়ি ছেড়ে আসে।

শুক্রবার রাজশাহী থেকে ‘শ্রাবন্তী’, দিবারাত্রি’, ‘সেতু’, ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘মহানগর’ নামের পাঁচটি বাস রংপুর গিয়ে ফেরত এসেছে। এর মধ্যে নামের প্রথম দুই অক্ষর ‘এম এবং ও’ শুধু মহানগর গাড়ির। এটিই হতে পারে সেই বাসটি।

এ বিষয়ে কথা বলতে মহানগর গাড়ির মালিক কিংবা চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মুনজুর রহমান পিটার জানান, মহানগর নামে কয়েকজন মালিকের গাড়ি চলাচল করে। কার গাড়িটি শুক্রবার রংপুর গিয়েছিল সেটা বলা মুশকিল।

পিটার দাবি করেন, ফিরোজ যে গাড়ির যাত্রী ছিলেন- সেটি মহানগর নয়। গাড়িটি পাবনার কোনো মালিকের বলে তিনি শুনেছেন।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ফিরোজ। ফিরোজ ২০১০ সালে নন্দীগ্রাম পাইলট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, ২০১২ সালে নাটোরের সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বগুড়ার সৈয়দ আহমেদ কলেজ থেকে ২০১৭ সালে সমাজকর্ম বিভাগ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী কলেজে।

ফিরোজের কৃষক বাবা কয়েক বিঘা জমি চাষ করে সংসার চালান। পড়ালেখা শেষে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে চেয়েছিলেন ফিরোজ। নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরে ফিরোজের বড় ভাই মিজানুর রহমানের কসমেটিক্সের দোকান আছে। তিনি বলেন, সবার ছোট ফিরোজকে নিয়ে তাদের পরিবারের বড় স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন এখন ফিকে।

চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, তার শরীরের হাত ছাড়া কোথাও কোনো সমস্যা নেই। হাতের কাটা অংশ যদি এখন শুকিয়ে যায় তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু এতে যদি এখন ইনফেকশন দেখা দেয়, তাহলেই বিপদ। এ জন্য উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।

মিজানুর আরও বলেন, আমরা চাই সরকার ফিরোজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। আর সুস্থতার পর যেন তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি দোষী চালকদেরও যেন শাস্তি নিশ্চিত হয়।

এদিকে চালকদের শাস্তির দাবিতে শনিবার মানববন্ধন করেছেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুরে রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে বক্তব্য দেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। দোষী চালকদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান। একই সঙ্গে ফিরোজের সুচিকিৎসা এবং তাকে ক্ষতিপূরণ
দেয়ারও দাবি জানান।

জানতে চাইলে নগরীর কাটাখালী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মণ জানান, দুর্ঘটনার পর রাতেই থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি (ডিডি) হয়েছে। এখন ফিরোজের বাবা বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন