চোখ হারানো মিলনের পরিবারের বিরুদ্ধে পাল্টা তিন মামলা
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কাজের মজুরি চাওয়ায় চাচাতো ভাইয়ের টেস্টারের আঘাতে দুই চোখ হারানো কিশোর বিল্লাল হোসেন মিলনের (১৬) পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে পাল্টা তিনটি মামলা করা হয়েছে। চোখের যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ায় মিলনকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
মামলা তিনটিতে মিলনের বাবা গিয়াস উদ্দিন, মা জাহানারা বেগম, বড় বোন মোছা. নাছরিন আক্তার ও ধর্ম বোনের স্বামী নুর নবীকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া দুই মামলায় ছোট বোন পারভীন আক্তারকে ও একটিতে মামা মো. লাবু মিয়াকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদীরা হলেন- মিলনের চোখ নষ্ট করার মামলায় প্রধান আসামি মামুনের (২৫) মা মোছা. আফরোজা বেগম, দুই নম্বর আসামি আলামিনের (১৯) মা মোছা. কুলছুম বেগম এবং মিলনের চাচা মো. নাজিম উদ্দিন। তাদের বাড়ি মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের রাজাবাড়ি বানিয়াচালা গ্রামে। হুমকি ও হত্যার ভয় দেখানোর অভিযোগে গত ২৯ ও ৩০ মে মামলাগুলো করা হয়।
মিলনের চোখ নষ্ট করার মামলায় তিন আসামির মধ্যে দুই আসামি মামুন ও তার সহকারী আলামিন গত ২৮ মে থেকে টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে রয়েছেন। মিলন উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের রাজাবাড়ি বানিয়াচালা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন ও জাহানারা বেগম দম্পতির ছেলে।
গত ১২ এপ্রিল মিলনের চোখ নষ্ট করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। মিলনের বাবা গিয়াস কারখানার শ্রমিক। একমাত্র ছেলে মিলন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার ছোট চাচা মজিবর রহমানের ছেলে মামুন ডিশ লাইন সংযোগের কাজ করেন। তার কাজে সহযোগিতা করত মিলন। তবে কাজের জন্য তাকে কোনো মজুরি দেয়া হতো না।
ঘটনার দিন ১২ এপ্রিল বিকেলে মামুন ফোন করে কাজের জন্য মিলনকে ডেকে নেয়। পরে মামুন ফোন করে জানান, মিলন কাজ করার সময় ভবনের ছাদ থেকে পড়ে আহত হয়েছে। তাকে মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মিলনের পরিবারের সদস্যরা ছুটে গিয়ে দেখেন সে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য মিলনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে ১৯ দিন চিকিৎসার পর ১ মে মিলনের জ্ঞান ফেরে। এরপরই জানা যায় পুরো ঘটনা।
মিলন আসলে পড়ে গিয়ে আহত হয়নি। মামুনের কাছে কাজের মজুরি চাওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্যুতের কাজে ব্যবহৃত টেস্টার দিয়ে মিলনের ডান চোখে সজোরে আঘাত করেন। এতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে মিলন। পরে তার বাঁ চোখেও আঘাত করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও মিলনের চোখ ঠিক করতে ব্যর্থ হন।
এ ঘটনায় মিলনের মা জাহানারা বেগম বাদী হয়ে গত ৯ মে টাঙ্গাইলের সিনিয়র বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় মামুন, আলামিন ও ডিশ ব্যবসায়ী কবির হোসেনকে।
২৮ মে মিলনের চাচাতো ভাই মামুন ও তার সহকারী আলামিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে রয়েছেন। ৩০ মে টাঙ্গাইলের বিচারিক হাকিম আদালতে (২ নম্বর) মিলনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
মিলনের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে উল্টো দায়ের করা মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে রাজাবাড়ি বানিয়াচালা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, ঈদের দিন (৫ জুন) মিলনের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করতে মামুনের বাবা মজিবর রহমান নিজেই তাদের ঘরের বিভিন্ন স্থানে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিত ঠিক করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের প্রতিবেশীরা জানান, শুধু ঘরে লাঠির আঘাত নয়। মিলনের পরিবারের সদস্যদের মারধর করতে তিনি লাঠিসোটাসহ ধারালো অস্ত্রও সংগ্রহ করেছিলেন। পুলিশ আসার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
মামলার বাদীদের মধ্যে মোছা. কুলছুম বেগম (আসামি আলামিনের মা) সাংবাদিকদের জানান, তার ছেলে নির্দোষ। তিনি নিজেই ছেলেকে পুলিশে দিয়েছেন।
অপর বাদী মিলনের চাচা নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী মর্জিনা বেগম জানান, মিলনের পরিবারের পক্ষ থেকে করা একটি মামলায় তাদের নাম থাকায় তারাও পাল্টা মামলা করেছেন।
প্রধান আসামি মামুনের মা ও অপর মামলার বাদী মোছা. আফরোজা বেগম বলেন, তারা যাতে মামলায় না ঠেকেন এজন্য মামলা করেছেন।
এদিকে চোখের যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ায় কিশোর মিলনকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। হাসপাতালে মিলনের সঙ্গে থাকা বড় বোন নাছরিন আক্তার জানান, মিলনের চোখে চিকিৎসকরা যে রিং পরিয়েছিলেন তা নিচে নেমে এসেছে। এ জন্য মিলনের চোখে জ্বালাপোড়া বেড়ে যেতে পারে। খুব যন্ত্রণা হওয়ায় তাকে আবার হাসপাতালে আনা হয়। মিলন এখন হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের ২ নম্বর ইউনিটের ৬ নম্বর বিছানায় ভর্তি রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফরিদুল হাসান জানান, রোববার দুপুরের পর কিশোর মিলনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যন্ত্রণা বাড়ার কারণ জানা যাবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মির্জাপুরের দেওহাটা ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম জানান, মামলার পলাতক আসামি কবির হোসেনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ঘটনার সঠিক তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এস এম এরশাদ/আরএআর/এমকেএইচ