কীটনাশক ছাড়াই লিচুর পোকা নিয়ন্ত্রণে ডলারের সফলতা
লিচু ছিদ্রকারী পোকা (litchi fruit borer) নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. জিএম মোরশেদুল বারী ডলার। কোনো ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই নিয়ন্ত্রণে এসেছে লিচুর প্রধান এ বালাই। সম্ভব হয়েছে নিরাপদ লিচু উৎপাদন।
দুই বছরের গবেষণা শেষে তার এই প্রযুক্তি পৌঁছেছে চাষি পর্যায়ে। সাশ্রয়ি হওয়ায় এ জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা সাড়া ফেলেছে স্থানীয় লিচু চাষিদের মাঝে। এ পোকার বৈজ্ঞানিক নাম Conopomorpha sinensis। শুটকীট-বাদামী সবুজাভ। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী কীট হলুদ। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এ পোকার বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়।
বোম্বাই জাতের লিচুতে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। অপেক্ষাকৃত কম আক্রমণ হয় চায়না-৩ জাতে। লিচুর প্রধান শত্রু এ পোকার আক্রমণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। কমে যায় উৎপাদিত লিচুর বাজার মূল্য। ফলে বাগান মালিক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
নতুন এ প্রযুক্তি নিয়ে কথা হয় বিজ্ঞানী ড. জিএম মোরশেদুল বারী ডলারের সঙ্গে। তিনি বলেন, মূলত ফলের বাড়ন্ত অবস্থায় পূর্ণ বয়স্ক পোকা বোঁটার কাছে খোসার নীচে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে বোঁটার কাছে ফলের শাশ ও বীজ খেতে থাকে। বোঁটার কাছে করাতের গুড়ার মতো পোকার মল জমে স্থানটি কলো হয়ে যায়।
ফলের গুটি পচে যায়, অপরিপক্ক ও পরিপক্ক ফল ঝড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি-মে মাসে গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। ডিম থেকে বেরিয়ে লার্ভা গাছের নরম ও কচি অংশ যেমন বিকাশমান ডগা, পত্রবৃন্ত প্রভৃতিতে ছিদ্র করে। আক্রান্ত ডগা ফ্যাকাসে ও ঢলে পড়া ভাব দেখায় এবং ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরে যায়।
ড. ডলার বলেন, তার এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিকর কীটনাশক মুক্ত লিচু উৎপাদন করা। দুই বছর ধরে তিনি জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেছেন। কীটনাশক ছাড়াই ফল ছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণে প্রায় শতভাগ সফলও হয়েছেন তিনি। চাষি পর্যায়ে এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা গেলে শতভাগ নিরাপদ লিচু উৎপাদন সম্ভব হবে।
এ বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ডলার বলেন, ফল মটরদানা আকারের হবার পর গাছ পুরোটাই ‘নেটিং’ করে দিতে হবে। এতে বাইরে থেকে ক্ষতিকর পোকা-মাকড় প্রবেশ করতে পারবেনা।
এর আগে গাছে নিমের তেল বা নিমের বীজ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি গাছে স্প্রে করতে হবে। ফল সংগ্রহের আগের ২০ দিনে কোনোভাবেই কীটনাশক প্রয়োগ করা যাবে না। ওই সময় জৈব বালাইনাশক স্পিনোসেড ১০ দিন পরপর দুই দফা প্রয়োগ করতে হবে। এর আগে ইমিডাক্লোরোপিড প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এতেই শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসবে ফল ছিদ্রকারী পোকা। এ পদ্ধতির বাইরে কেবল নেটিং করেও এ পোকা প্রতিরোধ সম্ভব। এ পদ্ধতিও ছিল গবেষণায়। তবে কেবল নেটিংএ সফলতার হার কিছুটা কম।
তাছাড়া বিরুপ আবহাওয়ায় আক্রমণ ঘটতে পারে এনথ্রাকনোজ। এ ক্ষেত্রে মুকুল ফোটার আগে এবং ফল পুষ্ট হবার সময় ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। নেট খুলে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পর আবারও নেটিং করে দিতে হবে।
জেলার চারঘাট উপজেলার অনুপমপুরের সোহেল রানার লিচু বাগানে এ প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে ফল গবেষণা কেন্দ্র। সম্প্রতি এ বাগান ঘুরে এসেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের একদল বিজ্ঞানী। এ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে স্থানীয় লিচু চাষিদেরও।
প্রদর্শনী লিচু বাগানের মালিক সোহেল রানা বলেন, তার দুই বিঘা আয়তনের বাগানে চাইনা-৩, বারি লিচু- ১ ও বোম্বাই জাতের ১৩টি লিচু গাছ। এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার পিছু ছাড়েনি।
তারপও দুই ধাপে লিচু বিক্রি করেছেন ৫০ হাজার টাকার। আরও ২০ হাজার টাকার লিচু বিক্রি হবে। গত বছর এর অর্ধেকও দাম পাননি। জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা তাকে লাভের মুখ দেখিয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, কৃষকরা না জেনে ইচ্ছেমতো লিচু বাগানে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। লিচুর বাইরের আবরণ পাতলা হওয়ায় এতে বিষক্রিয়া রয়েই যায়। এটি অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাগানে ইচ্ছেমতো কীটনাশক প্রয়োগ থেকে চাষিদের বিরত থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
এ গবেষক আরও বলেন, ফলের রাজা আম রাজশাহীর ঐতিহ্য। এর পাশাপাশি রাজশাহীতে বাণিজ্যিক লিচু চাষ বাড়ছে। নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল উৎপাদন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যারা নিরাপদ ফল উৎপাদন করছেন, তারা বাজারে ভালো দাম পাচ্ছেন। দিন দিন জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. দেবাশীষ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, জৈব রোগ বালাই ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ক্ষতিকর কীটনাশক থেকে মুক্তি দিতে পারে। বাগানে সময়মতো সার, সেচ এবং পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এই বিজ্ঞানী।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর লিচু বাগান রয়েছে রাজশাহ জেলায় ৪৬৫ হেক্টর, নওগাঁয় ২২১ হেক্টর, নাটোরে এক হাজার ১৪৫ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫৭ হেক্টর। গত বছর উৎপাদন ছিল রাজশাহীতে ৩ হাজার ১১৩ টন, নওগাঁয় ৮৪০ টন, নাটোরে ৬০ হাজার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক হাজার টন। এবার এটিই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে কৃষি দপ্তর।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/পিআর