উৎপাদন ৫ লাখ কেনা হচ্ছে ২ হাজার মেট্রিক টন ধান
জয়পুরহাটে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম নিম্নমুখী হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। যেখানে সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ধান চাষে কৃষকের খরচ হয়েছে ১২/১৩ হাজার টাকা সেখানে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী বিঘাপ্রতি উৎপাদিত ১৮/২০ মন ধান বিক্রি করে কৃষকরা পাচ্ছেন ৭/৮ হাজার টাকা। এ অবস্থায় কোনো কোনো কৃষকের আয়-ব্যয় সমান হলেও বেশির ভাগ কৃষককে গুণতে হচ্ছে লোকসান।
সরেজমিনে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে খোলা বাজারে মণপ্রতি মোটা ধানের বাজার ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ও চিকন ধান মণপ্রতি সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ২৬ টাকা (মণপ্রতি এক হাজার ৪০ টাকা) দরে মোট ২ হাজার ১৪ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে গত কয়েক দিনে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রির জন্য কৃষকদের উপস্থিতি আশানুরূপ লক্ষ্য করা যায়নি। এরপরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে বলে খাদ্য বিভাগ আশা করছে। এবারে জয়পুরহাটে চলতি বোরো মৌসুমে সরকারিভাবে জেলার ৫ উপজেলার ৬টি খাদ্য গুদামে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ চলবে ২২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সুধেন্দ্রনাথ রায় জানান, এই ইরি-বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন এবং প্রায় ৬০ ভাগ কৃষকের ধান কাটা শেষ হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদনের বিপরীতে সরকারি খাদ্য গুদামে প্রতিজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ এক মেট্রিকটন করে মাত্র দুই হাজার ১৪ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে বলে খাদ্য বিভাগ ঘোষণা দেয়। এতে সব কৃষক তাদের উৎপাদিত ধান সরকারিভাবে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন না।
কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ব্যাপারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও স্থানীয়ভাবে প্রচার-প্রচারণার অভাবে অধিকাংশ কৃষকই ধান বিক্রির বিষয়টি জানেন না। এ ছাড়া ধানের সঠিক আর্দ্রতা নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা, খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে এসে আর্দ্রতার কারণে ধান নিয়ে ফেরত যাওয়ার অসহনীয় দুর্ভোগসহ নানা বিড়ম্বনার ভয়ে কৃষকরা সরকারি খাদ্য গুদামে ধান নিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে কৃষকরা লাঙল, বীজ, সার, কীটনাশক, পানি, ধান কাটার শ্রমিকসহ ধান উৎপাদনের বিভিন্ন সামগ্রী ঋণে ক্রয় করে উৎপাদনের কারণে ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাওনাদারদের চাপে তাড়াতাড়ি করে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে গুদামে ধান দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও ধান না থাকায় গুদামে দিতে পারছেন না প্রান্তিক কৃষকরা। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছেন মধ্যসত্ত্বভোগী, চাতাল ও ধান ব্যবসায়ীরা। তারা কৃষকদের কৃষি সহায়তা কার্ড ৩০০ থেকে ১০০০ টাকায় সংগ্রহ করে তাদের মাধ্যমে খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি।
কালাই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের অজিমুদ্দিন, ফিতা মিয়া ক্ষেতলাল উপজেলার তালশন গ্রামের ইব্রাহিমসহ জেলার বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, ধানের চারা রোপণ, সেচ, কীটনাশকসহ সব মিলে তাদের বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১০/১২ হাজার টাকা। এখন বাজারে মোটা ধানের দাম মণপ্রতি ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত এবং চিকন ধানের বাজার দর মণপ্রতি ৫৭০ টাকা থেকে ৬২০ টাকা। এ অবস্থায় নিজের পারিশ্রমিকের মূল্য বাদ দিলেও তাদের বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে প্রায় ৩/৪ হাজার টাকা। এর সঙ্গে নিজেদের পারিশ্রমিক ধরলে লোকসান হবে ৫/৬ হাজার টাকা। দাম পেতে তারা সরকারের কাছে বেশি করে ধান কেনার আবেদন জানান।
জয়পুরহাট সদরের কড়ই-কাদিপুরের ওয়াজেদ আলী, মাদারগঞ্জের আজাদুল ইসলাম, বামনপুর চারমাথার লোকমান হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন জানান, সরকারি খাদ্য গুদামে ধান কেনার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম। কিন্ত আমাদের কাছে তো ধান নেই, আমরা কোথা থেকে ধান দেব। ধান অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছি।
জয়পুরহাট সদরের বামনপুর চারমাথার ধান ব্যবসায়ী উত্তম কুমার ও কোরবান আলী বলেন, গত মৌসুমের আমন ধান মজুত থাকায় ও বাজারে ধানের প্রচুর আমদানি হওয়ায় ধানের দাম কম। কৃষক ধান ধরে রাখতে পারলে দাম পাবে।
জয়পুরহাট সদর ও জেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস ছাত্তার মন্ডল বলেন, ব্যাপক ধান উৎপাদন হলেও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার অল্প পরিমাণ ধান ক্রয় করছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। তবে কৃষি সহায়তা কার্ড দেখে আগে আসলে আগে পাবেন এই ভিত্তিতে আমরা ধান ক্রয় করছি। একজন কৃষকের ৩ মেট্রিক টন ধান দেয়ার বিধান থাকলেও আমরা অধিক কৃষককে সুবিধা দেয়ার জন্য এক মেট্রিক টন করে ধান ক্রয় করছি।
রাশেদুজ্জামান/আরএআর/জেআইএম