জালিয়াতি করেই ২২ বছর ধরে শিক্ষক তিনি!
জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বগুড়ার নন্দীগ্রামের নুন্দহ সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান মোস্তাফিজুর রহমান। ১৯৯৭ সালে চাকরিতে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে ফের তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এবার তিনি নিয়োগ পান উপাধ্যক্ষ পদে। আর এভাবে অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও ২২ বছর ধরে বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। মাদরাসায় অধ্যক্ষের পদ শূন্য থাকায় বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
এদিকে মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রওশন খানের নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের তদন্ত কমিটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে চিঠি দিয়েছেন।
এছাড়া মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে মাদরাসাটির পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
ইবির তদন্ত কমিটির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কলেজের উপাধ্যক্ষ (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) পদে নিয়োগের জন্য আরবি প্রভাষক পদে অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও মোস্তাফিজুর রহমানের এ পদে অভিজ্ঞতা ছিল না। এ কারণে অভিজ্ঞতাবিহীন তার আবেদনপত্রও যথাযথ ছিল না। আরবি প্রভাষক পদে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে মোস্তাফিজুর রহমানকে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এজন্য নিয়োগ বোর্ড এবং মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদ দায়ী। এর আগে ২০১৪ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত দুই সদস্যের অপর এক তদন্ত কমিটি মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে সনদ জালিয়াতি করে চাকরি করার প্রমাণ পায়। তবুও এতদিন তিনি স্বপদে বহাল আছেন।
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (মাদরাসা বিভাগ) সূত্রে জানা গেছে, মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ এনে ২০১২ সালে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির তিন সদস্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ পেয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও মুসলিম বিধান বিভাগের মো. সেলিম তোহার নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন) আতাউর রহমান।
পরে তদন্ত কমিটি ২০১২ সালের ১৯ ও ৩১ জুলাই মাদরাসা পরিদর্শন করে নথিপত্র ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাই করে। এরপর ২০১৩ সালের ২১ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটির সদস্যরা উল্লেখ করেন, মোস্তাফিজুর ১৯৯৭ সালের ১৫ মার্চ ওই মাদরাসায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০১২ সালে উপাধ্যক্ষের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। সেখানে আরবি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। মোস্তাফিজুর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক পদে চাকরি করলেও ১৯৯১ সালে অর্জন করা মাদরাসা বোর্ডের ফাজিল পাসের সনদ ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ২০১২ সালে উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি ১৯৯১ সালে একই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিএসএস (অনার্স) ডিগ্রী এবং একই বছর ও একই শিক্ষাবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নুনদহ ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
আইন অনুযায়ী, একই শিক্ষাবর্ষে একই ব্যক্তি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নেয়া বিধিসম্মত নয়। তদন্তকালে অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর একই শিক্ষাবর্ষে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জনের বিষয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। নিজের অপরাধ স্বীকার করায় তদন্ত কমিটি মোস্তাফিজুরকে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক পদে পদাবনতির সুপারিশ করেন।
পরে তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মসলেম উদ্দিন ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
তবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তিনি কোনো জালিয়াতির আশ্রয় নেননি। একই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে সনদ গ্রহণ কোনো অন্যায় নয় বলে দাবি করেন তিনি। তাছাড়া বিধি অনুযায়ী তিনি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন বলেও জানান।
আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রওশন খান বলেন, তদন্তে কলেজের উপাধ্যক্ষ (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) পদে নিয়োগে সমস্যা পাওয়া গেছে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থা না নিলে পরবতির্তে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিমন বাসার/এফএ/এমকেএইচ