আসবাব কিনতে ও ফ্ল্যাটে ওঠাতেই সাড়ে ২৫ কোটি টাকা!
নির্মাণাধীন দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিনসিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়েছে। একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এরমধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি টাকায় আকাশ সমান দামে এসব আসবাবপত্র কেনার পর তা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে তুলতে অস্বাভাবিক হারে অর্থ ব্যয়ের এ ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতরের পাবনা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা। শুধুমাত্র আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে ওঠাতে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। নথিপত্র ঘেঁটে এমন তথ্যই উঠে এসেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে একটি সংবাদপত্র।
জানা গেছে, প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা দরে ১১০টি খাট কিনতে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টাকা। খাটগুলোর প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটে নিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা। একেকটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকা, ভবনে ওঠাতে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকা দরে কেনা সেন্টার টেবিলের প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৪৮৯ টাকা।
কেজিখানেক ওজনের একটি বৈদ্যুতিক কেটলি নিচ থেকে ফ্ল্যাটে তুলতেই খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। একই রকম খরচ দেখানো হয়েছে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেক্ট্রিক আয়রন ওপরে তুলতে। প্রায় আট হাজার টাকা করে কেনা প্রতিটি বৈদ্যুতিক চুলা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে খরচ দেখানো হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকার বেশি। ঘুমানোর জন্য প্রতিটি বালিশ ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা করে। আর একেকটি ওয়াশিং মেশিন ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে ওয়াশিং মেশিনসহ অন্তত ৫০টি পণ্য ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক, কোনো কোনোটিতে ৭৫ শতাংশ।
অস্বাভাবিক এই অর্থ ব্যয় কেবল ভবনে ওঠানোর ক্ষেত্রেই নয়, আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে। প্রতিটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে। এ হিসাবে ৩৩০টি চাদর কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকায়। ৩৩০টি বালিশের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে কাছাকাছি ব্যয়। কাপড় পরিষ্কারের জন্য ১১০টি ওয়াশিং মেশিনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা করে। ১১০টি টেলিভিশনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায় এবং সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে সাহাপুর ইউনিয়নের নতুনহাট মোড়ে হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। সেখানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য ২০তলা ১১টি ও ১৬তলা আটটি ভবন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০তলা আটটি ও ১৬তলা একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ২০তলা ভবনে ১১০টি ও ১৬তলা ভবনে ৮৬টি ফ্ল্যাট থাকবে।
নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া ৯টি ভবনের ৯৬৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাবপত্র কেনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে একটি ২০ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে ওঠাতে সব মিলে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয়ের এ হিসাব প্রকল্পের নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে। তবে প্রকল্পে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, নিয়ম মেনেই কেনাকাটা করা হয়েছে।
প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনার নথিপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ২০তলা ওই ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের জন্য ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা দরে ১১০টি টেলিভিশন কেনা হয়েছে ৯৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকায়। টেলিভিশনগুলো ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে আট লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা দরে মোট ১১০টি ফ্রিজ কিনতে খরচ হয়েছে এক কোটি ৩৬ লাখ সাড়ে সাত হাজার টাকা। সেগুলোর প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা।
একইভাবে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা দরে মোট এক কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা ১১০টি ওয়াশিং মেশিন ফ্ল্যাটে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ৩৮ হাজার ২৭৪ টাকা দরে কেনা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৮৪০ টাকা করে। ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের একেকটি সেট কেনা হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকায়, ভবনে তুলতে লেগেছে ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা করে। ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা দরে ওয়ারড্রব কিনে ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকা করে। ৩৬ হাজার ৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি মেট্রেস ও তোশক কেনা হয়েছে মোট এক কোটি ১৯ লাখ টাকায়, যার প্রতিটি ভবনে ওঠাতে খরচ করা হয়েছে সাত হাজার ৭৫২ টাকা করে। এরকম সব জিনিসের ক্ষেত্রেই অবাস্তব খরচ দেখানো হয়েছে যা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান বলেন, আমরা গণপূর্ত অধিদফতরের বিধিবিধান মেনেই কাজ করে থাকি। এখানে উন্মুক্ত দরপত্র দিয়ে মালামাল কেনাসহ অন্যান্য কাজ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই করা হয়েছে।
গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই এসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই খোঁজখবর না নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। যদি কোনো সমস্যা থাকে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, এ ধরনের একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে আসার পর দরদাম ও অন্যান্য বিষয়াদি দেখার জন্য কমিটি গঠন করে দিয়েছিলাম। এরপর তারা কী করেছে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
আলাউদ্দিন আহমেদ/এফএ/এমএস