রাজশাহীর আম বাণিজ্য শুরু
ফলের রাজা আম উঠতে শুরু করেছে বাজারে। বুধবার মৌসুমের প্রথম গুটি জাতের আম গাছ থেকে নামিয়েছেন চাষি ও বাগান মালিকরা। এর মধ্যদিয়ে শুরু হলো এই মৌসুমের আম বাণিজ্য।
কয়েক বছরের টানা লোকসানের পর এবার অন্তত ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা চাষি ও বাগান মালিকদের। আমচাষি ও বাগান মালিকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই রাজশাহীর আম নিয়ে অপপ্রচার চলছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অঞ্চলের আমের বাজার। তবে এবার সেই শঙ্কা নেই। এবার ফলও বেশ ভালো। আর রাজশাহীর আমের বাণিজ্য হবে জমজমাট।
বুধবার (১৫ মে) থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে দেশি গুটি জাতের আম। প্রথম দিনই বিপুল পরিমাণ গুটি আম উঠেছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। তবে সুস্বাদু আম পেতে আরও পাঁচদিন অপেক্ষা করতে হবে ভোক্তাদের। আগামী ২০ মে বাজারে নামবে গোপাল ভোগ জাতের আম। এরপর ২৫ মে রাণী প্রসাদ ও লক্ষণ ভোগ এবং ২৮ মে নামবে হিমসাগর। এছাড়া ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি ও ফজলি ১৬ জুন এবং আশ্বিনা নামানো শুরু হবে ১ জুলাই থেকে।
এদিকে অপরিপক্ব ও কেমিক্যালমুক্ত আম বাজারজাত নিশ্চিতে বাগান ও আড়তগুলোতে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে মাঠপ্রশাসন। এর আগে চাষি ও বাগান মালিকদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও করেছে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ।
আম বাণিজ্য শুরুর প্রথম দিনে রাজশাহীর অন্যতম বাজার বানেশ্বরের আড়তগুলোতে উঠেছে বিপুল পরিমাণ গুটি আম। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে সেগুলো নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা। প্রথম দিনে প্রতিমণ গুটি জাতের আম বিক্রি হয়েছে দেড় হাজার থেকে ১৬শ’ টাকায়।
তবে এখনও জমেনি আম বাজার। বানেশ্বর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আম কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আড়তদাররা। আম রাখার জায়গায় চলছে ধোয়া-মোছা। কোথাও কোথাও গড়ে উঠছে অস্থায়ী ঘর। কয়েক হাজার মৌসুমী শ্রমিক কাজ করেন আমের আড়তে। শেষ মুর্হূতে চলছে শ্রমিকদের সঙ্গে আড়ত মালিকদের মজুরি নিয়ে দরদাম।
বানেশ্বরের আড়তদার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, বুধবার সকাল থেকেই বাজারে এসেছে দেশি গুটি জাতের নাম। কেনাবেচাও শুরু হয়েছে সকাল সকাল। বাজারে আমের চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। প্রথমদিন প্রতিমণ গুটি আম বিক্রি হয়েছে অন্তত দেড় হাজার টাকায়।
সিরাজগঞ্জ থেকে বানেশ্বরে আম কিনতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, আম কেনাকাটা শুরুর আগের দিনই তিনি মোকামে চলে এসেছেন। প্রথম দিনেই কিছু আম কিনেছেন। সেগুলো পাঠিয়ে দিয়েছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পুরো মৌসুমে প্রত্যেক বছর আম ব্যবসা করেন তিনি।
জানতে চাইলে পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওলিউজ্জামান বলেন, কোন আম কখন পাড়তে হবে সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমচাষি, বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের। অপরিপক্ব আম বাজারজাত রোধে সার্বক্ষণিক নদরদারিতে থাকছে আম আড়তগুলো। এ ছাড়া কোথাও কোনো অনিয়মের খবর পেলে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের জানিয়েছেন, বেধে দেয়া সময়সীমার আগে যাতে কেউ আম নামাতে না পারেন এ জন্য বাগান তদারকি করছে ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ। দেশ বিখ্যাত রাজশাহীর আমের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতেই এ উদ্যোগ।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, কোন আম কখন বাজারে নামবে সেই বিষয়টি মাখা রাখতে হবে ভোক্তাদেরই। আমের প্রকৃত স্বাদ পেতে এর বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, এবারের আবহাওয়া আমের অনুকূলে ছিল। ফলে আম চাষে এবার চাষি ও বাগান মালিকদের খরচ হয়েছে তুলনামূলক কম। তাছাড়া আমের ফলন হয়েছে সন্তোষজনক। সময়মতো আম বাজারজাত করা গেলে রাজশাহীর আমের স্বাদ পাবেন ভোক্তারা।
ফল গবেষণা কেন্দ্র বলছে, রাজশাহী জেলায় এবার আমের চাষ হয়েছে সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে। আর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ সাড়ে ১৩ হাজার টন।
অন্যদিকে, আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং নাটোর জেলায় সর্বশেষ গত ২০১৭-২০১৮ কৃষিবর্ষে আমবাগান ছিল ৭০ হাজার ৩৪৬ হেক্টর। তা থেকে আম উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬১ টন। এটিই এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা।
এর আগে ২০১১-২০১২ কৃষিবর্ষে রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগান ছিল ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর। সেইবার আম উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন। এছাড়া ২০১৪-২০১৫ কৃষিবর্ষে ৫৪ হাজার ৭২২ হেক্টর বাগানে আম উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৩৬ টন।
সীমিত হলেও গত কয়েক বছর ধরেই এই অঞ্চল থেকে আম রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আর এ জন্য রাসায়নিকমুক্ত আম উৎপাদন করছেন চাষিরা। ভালো দাম পাওয়ায় এবারও প্রস্তুত হচ্ছেন তারা।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/বিএ