ব্যবসায়ীকে ডেকে এনে পেটালেন এএসপি ও তার বডিগার্ড
বিনা অভিযোগে ব্যবসায়ীকে পুলিশ লাইন্সে ডেকে নিয়ে মাটিতে ফেলে নিজে ও বডিগার্ডকে দিয়ে লাঠি দিয়ে বেধরক মারপিট করার অভিযোগ উঠেছে বগুড়ার (শিবগঞ্জ ও সোনাতলা সার্কেল) সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই-খুদার বিরুদ্ধে।
মারধরের পর ওই ব্যবসায়ীকে পুলিশ লাইন্সের বাইরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। গত রোববার রাত ১১টার দিকে বগুড়া পুলিশ লাইন্সের অফিসার্স মেসে এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই-খুদার বিরুদ্ধে এর আগেও বগুড়ার একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে অপ্রতীকর ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে।
নির্যাতনের শিকার ওই ব্যবসায়ীর নাম আহমেদ সাব্বির। বগুড়া শহরের সুত্রাপুর এলাকায় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ সড়কে আর্ট লাইন কমিউনিকেশন নামে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত দেড় বছর ধরে বগুড়া জেলা পুলিশের কাছে তিনি ছাপাখানা মুদ্রণের কাজ ছাড়াও ক্রোকারিজসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী সরবরাহ করে আসছিলেন।
সাব্বির বলেন, রোববার ইফতার ও তারাবির পর তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই কাজ করছিলেন। রাত সাড়ে দশটার দিকে সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই খুদা তাকে ফোন করে পুলিশ লাইন্স অফিসার্স মেসের সামনে উপস্থিত হতে বলেন। এ সময় মুঠোফোনে তিনি বলেন, 'তুই না আসলে থানা থেকে পুলিশ পাঠিয়ে তোকে তুলে আনবো'। ভয়ে সাব্বির নিজে থেকেই পুলিশ লাইন্সে যান।
সাব্বিরের অভিযোগ, রাত ১১টার দিকে সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই-খুদা অফিসার্স মেসের সামনে উপস্থিত হন। এরপর নিউ মার্কেটের ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদকে ফোনে ডেকে নেন। এরপর কালাম সেখানে উপস্থিত হলে কেন তার মগের পুরো টাকা শোধ করা হয়নি সাব্বিরের কাছে কৈফিয়ত চান সহকারী পুলিশ সুপার। এ সময় সাব্বির বলেন, ফটো বইয়ের দেড় লাখ টাকা ছাপাখানায় শোধ দেয়ায় মগের টাকা শোধ দিতে পারিনি। আগামী সপ্তাহে মগের টাকা শোধ করে দেব।
এরপর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার প্রথমে তার বডিগার্ডকে ডেকে সাব্বিরকে পেটানোর নির্দেশ দেন। বডিগার্ড তৌকির গাড়ি থেকে লাঠি এনে বেধরক পেটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে সহকারী পুলিশ সুপার নিজেই লাঠি কেড়ে নিয়ে বেধরক পেটাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে সাব্বির মাটিতে পড়ে গেলেও রক্ষা মিলেনি। বেধরক পেটানোর পর গুরুতর আহত হলে দুজন পুলিশ সদস্যকে ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, শালাকে পুলিশ লাইন্সের বাইরে ফেলে দাও। এরপর রাত ১২টার দিকে দুজন পুলিশ একটি রিকশা ডেকে সাব্বিরকে তুলে দেন।
পরে তিনি মফিজ পাগলার মোড়ে ডক্টরস ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর রাতেই জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে সদর থানায় সাধারণ ডায়েরির জন্য লিখিত আবেদন করেন। কিন্ত ঊর্ধ্বতন অফিসারের বিরুদ্ধে হওয়ায় পুলিশ ডায়েরি নিতে অস্বীকৃতি জানান।
পুলিশের কাছে দায়ের করা লিখিত অভিযোগ এবং নির্যাতিত ব্যবসায়ীর সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া শহরের সুত্রাপুরে ছাপাখানা মুদ্রণ ও মালামালা সরবরাহ, অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা (ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট) এবং বিজ্ঞাপণী সংস্থার ব্যবসা করেন সাব্বির। গত দেড় বছর ধরে তিনি বগুড়া জেলা পুলিশে ছাপাখানা ও মুদ্রণ সংক্রান্ত মালামাল সরবরাহ করছেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন আলোকচিত্রীর তোলা নির্বাচিত আলোকচিত্র সম্বলিত ৪০০ কপি ফটোবুক তৈরির মৌখিক অর্ডার দেন। প্রতিটি কপির মূল্য ৬০০ টাকা হিসেবে দুই লাখ ৪০ হাজর টাকা বিল পরিশোধের কথা ছিল। অর্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে এসব ফটোবুক সরবরাহ করা হলেও মান ভালো হয়নি এমন অজুহাতে বিল দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।
সার্বিরের অভিযোগ, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার (হেড কোয়ার্টার) খুদরত-ই-খুদা শুভকে বিল পরিশোধের জন্য অনুরোধ করা হলেও তিনি অদ্যবধি একটি টাকাও দেননি। সাব্বির অভিযোগ করেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা পুলিশের বার্ষিক পুলিশ সমাবেশ এক হাজার পিছ সিরামিকের স্মারক মগ সরবরাহের জন্য অর্ডার দেয়া হয়। সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই-খুদার সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয়, ৭০০টি মগ ১৩০ টাকা হিসেবে ৯১ হাজার টাকা এবং অবশিষ্ট ৩০০ মগ ১৪৫ টাকা হিসেবে ৪৩ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করার। সহকারী পুলিশ সুপার তিন কিস্তিতে সব্বিরকে ওই টাকা পরিশোধ করেন। এখানে মোট ৩ কিস্তিতে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা দেয়া হলেও সাব্বিরের নাম করে ১ হাজার ২০০ মগ সরবরাহ নেয়ার কথা বলে পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ তহবিল থেকে এক লাখ ৯২ হাজার টাকা তুলে নেন।
সাব্বির ওই মগ ১ লাখ ২৪ হাজার টাকায় সরবরাহ নিয়েছিলেন শহরের নিউ মার্কেটের ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে। ইতোমধ্যেই সেই ব্যবসায়ীকে ৯০ হাজার টাকা পরিশোধও করেন সাব্বির। অবশিষ্ট ৩৪ হাজার টাকা শোধ দেয়ার জন্য ব্যবসায়ী আজাদ সাব্বিরকে চাপ দেন। নিরুপায় হয়ে সাব্বির সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই খুদাকে ফটো বইয়ের বিলের একটা ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। এতে সাব্বিরের ওপর ক্ষিপ্ত হন সহকারী পুলিশ সুপার।
বগুড়া নিউমার্কেটের ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি সাব্বিরের কাছ থেকে পাওনা টাকার ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোনো নালিশ বা অভিযোগ করেননি। সহকারী পুলিশ সুপার নিজে থেকেই তাকে পুলিশ লাইন্সে ডেকে নেন। তবে সব্বিরকে মারধরের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত সহকারী পুলিশ সুপার খুদরত-ই-খুদা শুভর মোবাইলে বারবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে মোবাইলে ম্যাসেজ করেও কথা বলার অনুরোধ জানালেও সাড়া দেননি।
পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ব্যবসায়ী সাব্বিরকে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে বলেছি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিমন বাসার/এমএএস/এমএস