বনানীতে একজনও মারা যেত না, যদি...
এমন দুঃসহ স্মৃতি আমায় কখনো ভালো থাকতে দেবে না। জানি না আমি কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারব। এই স্মৃতির প্রত্যেকটা সময় আমায় ভাবায় এবং কাঁদায়। চেনা মানুষগুলো আমার চোখের সামনে এভাবে মৃত্যুর মুখে পড়ে গেলো। আমরা সবাই বেঁচে ফিরতে পারতাম, যদি একটা ফায়ার অ্যালার্ম থাকতো। একজনও মারা যেত না। সবাই বেরিয়ে আসতে পারতো। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। মনে হচ্ছে দুনিয়ায় আমি দ্বিতীয়বার জীবন পেয়েছি।
রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে বিভীষিকাময় মুহূর্তের কথাগুলো মঙ্গলবার এভাবেই বলেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মোরশেদ জাহান হিমু।
ফেনী শহরের বিরিঞ্চি এলাকার কদলগাজী রোডের বাসিন্দা রেলওয়েতে কর্মরত শাহজাহান বাবুলের একমাত্র ছেলে মোরশেদ জাহান হিমু (২৭)। তার এক বোন ফেনী সরকারি কলেজে অনার্সে অধ্যয়নরত।
২০১০ সালে ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১২ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন মোরশেদ জাহান হিমু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়নরত হিমু পড়াশোনার পাশাপাশি হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস লিমিটেডে চাকরি করছেন। ২২ তলা ভবনটির ১০তলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় ছিল।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হিমু বলেন, গত ৬ মাস আগে হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস লিমিটেডে চাকরি নিই। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৮ম তলায় আগুন লাগে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের এমডি ফয়েজুল ইসলাম স্যার ফোনে বললেন ছাদে যেতে। কিন্তু আমরা কেউ যেতে পারিনি। তখন সবাই পরিবারের সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত। সহকর্মী আবু হেনা ইফতি ফোনে স্বজনদের বলছিলেন বেঁচে ফিরলে দেখা হবে। তার এ কথায় আমি ঘাবড়ে যাই। নিচেও নামতে পারছি না, উপরেও উঠতে পারছি না। কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখলাম একটি গ্লাস আছে। ঝুঁকি জেনেও ওই গ্লাসটি ভেঙে ভবনের বাইরে এসির জন্য তৈরি লোহার ওপরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। প্রথমবার সাহস না পেয়ে ভয়ে অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়ি। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করি। পরে ভাবলাম- লাফ দেবো, যা হওয়ার হবে।
এ সময় দেখি বাইরে বিদ্যুৎ, ডিস ও ওয়াফাইসহ আরও কিছু কেবলের তার। পা দিয়ে টেনে ধরে সেগুলোতে ঝুলে পড়লাম। ২০ মিনিট ধরে ঝুলতে থাকলাম। মনে সাহস নিয়ে আস্তে আস্তে নামতে থাকলাম। ৫ম কিংবা ৪র্থ তলা পর্যন্ত নেমে আটকে যাই। ততক্ষণে শরিরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলি। ৩য় তলা পর্যন্ত নামার পর নিচে উৎসুক লোকজন সাহস দিচ্ছিলেন। ভারী একটা কিছু ডান হাতে পড়ে আঘাত পাই। যখন নামছিলাম তখন একটি বারের জন্যও নিচের দিকে তাকাইনি। ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবি হয়তো আর আল্প একটু। শরীরে শক্তি না থাকলেও মনোবল নিয়ে নামতে থাকি। ১০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছে তখন একজনের কাঁধে পা রেখে ভর করে নেমে ফুটপাতে বসি। তখনো ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স কিংবা কোনো সাহায্যকারী সংস্থা এসে পৌঁছেনি।
পরে ফুটপাত থেকে তাকিয়ে দেখি আমাকে অনুসরণ করে অফিসের পিয়ন বেলাল ও এক সহকর্মী নেমে আসেন। মামুন ভাই ১০ তলা থেকে পড়ে মারা যান। মুনির ভাই দুইজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে মারা যান। জেমি ভাই, রুমকি আপা দুইজনই স্বামী-স্ত্রী। চাকরি করতেন আমাদের একই অফিসে। রুমকি আপা দম বন্ধ হয়ে মারা যান। জেমি ভাই লাফ দিয়ে মারা যান। খবর পাই আমার অফিসের ১০ জন সহকর্মী বেঁচে নেই।
হিমু আরও বলেন, আমি নামার সময় অন্য সহকর্মীদের নামতে সাহস জোগায়। কিন্তু কেউ সাহস করেননি। সাহস হারিয়ে তারা জীবনের আশা ছেড়ে দেন। অনেকে দম বন্ধ হয়ে মারা যান। পরবর্তীতে আগুনে তাদের মরদেহ পুড়ে যায়। জেবিন আপুকে (জেবুন্নেসা) বেশি মিস করছি। তার কোনো ভাই নেই। তিনি আমাকে ভাই বলে ডাকতেন। তিনি শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন। তাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। তানজিলা আপুর শরিরের ৯৮ শতাংশ পুড়ে যায়।
গত ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। এখন পর্যন্ত বনানীর আগুনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শতাধিক।
রাশেদুল হাসান/এএম/এমএস