নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দান করে মানবতার সেবায় ইউশি
৭১ বছর বয়সী জাপানি নাগরিক ইউশি ইওয়াকি। বাংলাদেশের কারও সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও বারবার ছুটে আসেন লাল-সবুজের দেশে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারবার বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। কখনো বই-খাতা, কখনো বা খেলনা হাতে ইউশি দাঁড়িয়েছেন ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সামনে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাসিমুখ ভুলিয়ে দেয় তার সব কষ্ট।
গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) ঢাকার ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’র অধ্যাপক ড. তৌফিকুল ইসলামের মাধ্যমে ইউশি ইওয়াকি শিক্ষা উপকরণ নিয়ে এসেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মোহাম্মদপুরের হাজী আব্দুর রহিম বিদ্যানিকেতনে। এদিন সন্ধ্যায় ড. তৌফিকুল ইসলামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের ফুলবাড়িয়ার বাসায় জাগো নিউজের মুখোমুখি হন ইউশি ইওয়াকি।
নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দান করে ইউশি এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশ ঘুরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অর্থের অভাবে নিজে ডাক্তারি পড়তে না পারার আক্ষেপ ঘুচাতেই শিক্ষার প্রতি ইউশির এই অনুরাগ।
১৯৪৮ সালের ২৫ মে জাপানের শিগা জেলার কুছাতসু শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইউশি ইওয়াকি। দুই বছর বয়সে ইউশি তার বাবা ও কলেজে অধ্যয়নের সময় মাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হবার। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হয়নি ইউশির। তখন থেকেই তার মনে প্রচুর অর্থ উপার্জনের জেদ কাজ করতে থাকে। তাই শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করার।
ইউশি জানান, তার মালিকানাধীন ‘ক্ষীয়এ কোম্পানি লিমিটেড’ জাপানের বিভিন্ন সুপারশপগুলোতে তাজা শাক-সবজি ও ফল-মূল সরবরাহ করত। পরিবারে সবার ছোট হয়েও নিজের ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি বড় ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণও পরিশোধ করেন ইউশি। ২৩ বছর ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হন তিনি। যে বছর তার প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করে সে বছরই ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন ইউশি। এরপর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার স্ত্রী হিরোমি প্রতিষ্ঠান বিক্রি না করে সেটি কর্মীদের দান করে দিতে বলেন। স্ত্রীর কথা মতো তিনি তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দান করে দেন।
ইউশি আরও জানান, গত চার বছর আগে তার স্ত্রী হিরোমি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। একমাত্র মেয়ে মিহো চাকরির সুবাদে বছরের অর্ধেক সময় থাকেন জাপানের বাইরে। সেজন্য ইউশিও বিভিন্ন দেশে ঘুরে-বেড়ান। তবে অর্থের অভাবে ডাক্তার না হওয়ার আক্ষেপ এখনো রয়েছে তার। প্রথম থেকেই ইউশির চিন্তা ছিল তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফার একটি অংশ তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবেন। তিনি কুছাতসু শহরের রোটারি ক্লাবের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তখন তিনি অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তিনি মনে মনে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করেন।
এরই অংশ হিসেবে ইউশি দেশে-দেশে ঘুরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণসহ আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকেন। এছাড়াও প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থীকে জাপানের মানুষের উচ্চবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে নিজ খরচে সেখানে নিয়ে যান ইউশি। গত বছর ঢাকার ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’র ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ খরচে জাপানে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরে করে ইউশি বলেন, বাংলাদেশের সড়কে একপাশে দামি গাড়ি চলে আরেকপাশে মানুষ না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। এই দৃশ্য তার হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বসূত্র হচ্ছে শিক্ষা। অথচ এদেশে যারা সামর্থবান তাদের সন্তানরাই পড়ালেখা করতে পারছে। জাপানে শিক্ষার হার শতভাগ বলেই জাপান এতো উন্নত। জাপানে কোনো প্রতিষ্ঠানকে যদি কর কমাতে হয় তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হয়। জাপানের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছে বলে শিক্ষার হার শতভাগ। শিক্ষা ছাড়া অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। আমি নিজেও আমার বন্ধুদের নিয়ে বাংলাদেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই প্রকৃতভাবে বাংলাদেশ উন্নত হবে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ইউশি বলেন, বাংলাদেশ জাপান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। এদেশের বিশাল যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের অধিকাংশ যুবক দেশের বাইরে পাড়ি জমায় কাজের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে যদি বিদেশি বিনোয়াগকারীরা আসেন তাহলে এই যুবকদের দেশের বাইরে যেতে হবে না। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন বাংলাদেশে এসে কোনো বাধার সম্মুখীন কিংবা প্রতারিত না হন সেই ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। একজন বিনিয়োগকারী এসে যখন দেখবে বাংলাদেশে তিনি কম টাকায় শ্রমিক পাচ্ছেন এবং তাকে কেউ হয়রানি করছে না তখন তিনিই বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর হয়ে অন্যদেরও এদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবেন। আর এভাবেই অর্থনৈতিকবাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’র সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তৌফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জাপানে গিয়ে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে ইউশির সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ই-মেইলে অনেকবার যোগাযোগ হয়েছে আমাদের। তখন থেকেই ইউশি বাংলাদেশ নিয়ে আমাকে তার আগ্রহের কথা জানান। সেই আগ্রহ থেকেই তিনি ২০১৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে কাজ করছেন সেটি আমাদের সবার করা উচিত। আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান আছেন। তারা চাইলেই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে পারেন। শিক্ষার মাধ্যমেই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হবে।
আরএআর/এমএস