রাজশাহীতে পরিবার পরিকল্পনা সেবার বেহাল দশা
রাজশাহীতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবা কার্যক্রমে বেহাল দশা বিরাজ করছে। জেলার ৪৫ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (এফডব্লিউসি) নেই পর্যাপ্ত জনবল। পরিচালনা কমিটিরও খবর নেই। ফলে সেবা নিতে গিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককেই।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর বলছে, জেলায় তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক। গত এক দশকে সব সূচকেই তাদের উন্নতি হয়েছে। সংকট সত্ত্বেও সেবার পরিধি বেড়েছে।
২ হাজার ৪০৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৩। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের হিসাবে, গত বছরের ডিসেম্বরে জেলায় সক্ষম দম্পতি ছিল ৬ লাখ ১৩ হাজার ২১০। এদের মধ্যে ৫ লাখ ৪ হাজার ২০৫ জন আসেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সেবার আওতায়। শতকরা হিসাবে যা ৮২ শতাংশের ওপর।
সূত্র জানায়, জেলার ৭২টি ইউনিয়নের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৪৫টিতে। এর মধ্যে ভালোভাবে সেবা কার্যক্রম চলছে মাত্র তিনটিতে। একেবারেই বেহাল অবস্থা সাতটির। বাকি ৩০টিতে সেবা কার্যক্রম চলছে জোড়াতালি দিয়ে।
এর বাইরেও জেলায় ৩০টি মান উন্নীত (প্রসব সেবা) পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ২৭টি সার্বক্ষণিক প্রসব সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। কিন্তু পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ও আয়ার পদ শূন্য থাকায় ব্যাহত হচ্ছে সেবা কার্যক্রম।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সেবা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে অধিকাংশ গ্রামীণ জনগণ। তাছাড়া শহর এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকজনও এসেছে। চাহিদামাফিক বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রক সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু জনবল সংকট ও পরিচালনা পর্ষদের নিষ্ক্রিয়তায় মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর কার্যক্রম গতিশীল করা যাচ্ছে না।
কর্মকর্তাদের ভাষ্য, প্রায় ১ হাজার ৮০০ দম্পতি নিয়ে জেলায় কাজ করছেন মাত্র একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী। অনুমোদিত ৪৩২ পদের বিপরীতে কর্মরত ৩৯৪ জন। পরিবার কল্যাণ সহকারীর ১২৮টি পদ শূন্য।
পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা পদ খালি ২০টি। অনুমোদিত ৯৭ পদের বিপরীতে এই পদে কর্মরত ৭৭ জন। ৭৬টি পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক পদের বিপরীতে কর্মরত ৬৫ জন। ৪০টি পদের বিপরীতে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার রয়েছেন ৩৮ জন। বিভিন্ন প্রশাসনিক পদও শূন্য দীর্ঘদিন ধরেই।
অবকাঠামো সংকটও ব্যাপক। জরাজীর্ণ ২০টি এফডব্লিউসি পুনর্নির্মাণ জরুরি। সংস্কার জরুরি আটটির। এরই মধ্যে ছয়টি এফডব্লিউসি সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সংস্কারকাজ চলছে আরও চারটির। অধিকাংশ ইউনিটের সীমানা প্রচীর না থাকায় নিরাপত্তা শঙ্কাও রয়েছে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার সরনজাই সরকারপাড়া এফডব্লিউসির ভবন ও জনবল রয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু ভাঙাচোরা সংযোগ সড়কের কারণে সেবা গ্রহিতারা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। নানা সংকটে উপজেলার বাকি চার এফডব্লিউসি।
উপজেলার কালনা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আলম হোসেন বলেন, লোকমুখে পরিবার পরিকল্পনার কথা শুনেছি। কিন্তু এ-সংক্রান্ত বার্তা নিয়ে আমার কাছে কেউ আসেননি।
একই ভাষ্য ওই গ্রামের কয়েকজন দম্পতির। তবে নিজ দায়িত্বে সেবা কেন্দ্রে গিয়ে সেবা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দম্পতি।
উপজেলার সরনজাই সরকারপাড়া এফডব্লিউসি পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হলেও তিনি যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। ফলে সেবা কার্যক্রম চলছে সমস্যা। কমিটির কার্যক্রম আরও গতিশীল করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
একই দশা জেলার অন্যান্য এফডব্লিউসিতেও। তবে কোথাও কোথাও সেবা কার্যক্রম চলছে বেশ ভালোভাবে। জেলার বাগমারা উপজেলার বেশ কয়েকটি এফডব্লিউসি পরিচালনা পর্ষদ নিজ উদ্যোগে ইজিবাইক অ্যাম্বুলেন্স চালু করেছে। অন্যান্য কার্যক্রমও চালাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। এর সুফলও পাচ্ছে জনগণ।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলার ভারপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাসিম আখতার। তিনি বলেন, পরিচালনা কমিটিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই অকার্যকর। ফলে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাঠ কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনবল সংকটও রয়েছে প্রকট।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশে। তবে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে। অন্যান্য সূচকেও গত এক দশকে উন্নতি হয়েছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের।
আরএআর/এমকেএইচ