খাগড়াছড়ির ‘সংসার ভাঙা সফল নারী’ বীনা ত্রিপুরা
বীনা রাণী ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির সফল সংগ্রামী নারীর নাম। জেলা শহরের কাছাকাছি খাগড়াপুর গ্রামে জন্ম। বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আর মা গৃহিণী। বেড়ে ওঠা খাগড়াপুরেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মা-বাবার ইচ্ছেতে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বামীর সংসারে পা রাখেন বীনা ত্রিপুরা।
বিয়ের ১৮ বছরের মাথায় ২০১৫ সালে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একলা পথ চলা শুরু করে বীনা রাণী ত্রিপুরা। একলা পথে হাঁটতে হাঁটতে এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী বীনা রাণী এখন ‘সংসার ভাঙা এক সফল নারী’।
একসময় শখের বসে ঘরে সেলাই কাজ করলেও সেই সেলাই কাজই আজ তাকে খাগড়াছড়ির রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। স্বামীর ডিভোর্সের পর যখন দুই সন্তান নিয়ে হতাশা ডুবে যাচ্ছিলেন তখনই প্রতিবেশী এক মাসির (খালা) পরামর্শে ২০১৫ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের ছয়মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রশিক্ষণ শেষে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের ৫০ হাজার টাকা ঋণ আর প্রতিবেশী চন্দনা ত্রিপুরার দেয়া ২০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে ‘হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি দোকান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন রূপে নিজের সংগ্রামী জীবন শুরু করেন খাগড়াপুরের বাসায়।
বীনা রাণী ত্রিপুরা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর সামাজিক দুর্দশা দেখে মাতৃতুল্য চন্দনা ত্রিপুরা নিজের গলার হার বিক্রি করেই বীনাকে আলোর পথ দেখান জানান খোদ বীনা রাণী ত্রিপুরা নিজেই।
একমাত্র মেয়ে হেমী ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি পুলিশ লাইন্স স্কুলে পড়ছে। ২০১৬ সালে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকেও কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তি পেয়েছে মায়ের ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠা হেমী ত্রিপুরা। আর একমাত্র ছেলে অর্কিড ত্রিপুরা ঢাকায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে।
‘হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বীণা ত্রিপুরা নিজেই ঘুরে দাঁড়াননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ রকম অসংখ্য অসহায় নারী। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ জন নারী তার প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শিখে পরিবারের যোগাচ্ছেন বাড়তি আয়। তাদের কেউ শিক্ষাজীবন থেকে ঝরেপড়া, কেউ হত-দরিদ্র, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা। খাগড়াছড়ি সদরের তৈবাকলাই-গাছবান ছাড়িয়ে সেই দুর্গম সাজেক-তৈচুই থেকে এসেও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অনেকেই।
বাস্তবিক অর্থে রাণী না হলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাগড়াছড়িতে সংগ্রামী নারীদের রাণী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বীনা রাণী ত্রিপুরা। শূন্য থেকে ‘হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ এর পুঁজি তিন লাখ টাকার চেয়েও বেশি। প্রতি মাসে গড়ে আয় করেন ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
‘হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ থেকে কাজ শিখেই আয়ের পথে হাঁটছেন খাগড়াছড়ি জেলা শহরের ইসলামপুরের মুন্নী আকতার ও কুমিল্লা টিলার জয়নব আকতার, নাসরিন আকতারের মতো নারীরা। নিজের ঘরে সেলাই ছাড়াও অর্ডার পাচ্ছেন পাড়া-প্রতিবেশীরও।
গেল বছরের পহেলা নভেম্বর সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন ‘জাতীয় যুব পদক ২০১৮’। যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বললেন বীনা রাণী ত্রিপুরা। এ ছাড়াও ২০১৮ সালে অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা’র পুরস্কার।
জীবনে চলার পথে সমাজের প্রায় সব মানুষের মুখেই নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা শুনতে শুনতে এগিয়ে গেছি। এ সমাজ প্রকৃত অর্থেই নারীদের জন্য বৈরি। বলেছেন সফল সংগ্রামী বীনা রাণী ত্রিপুরা। তিনি বলেন, এখন অমাকে নিয়ে কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করে না।
নিজে ভালো আছি, অন্য অনেক নারীকে আলোর পথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। সমাজের বঞ্চিত নারীদের সেলাই কাজ শেখানোর জন্য দুয়ার খোলা রেখেছেন জানিয়ে এ নারী বলেন, ‘এখন বিভিন্ন বয়সী সাতজন নারী এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ কাজ শিখে বাসা বাড়িতে বসেই বাণিজ্যিকভাবে আয় করছেন।’
সংসারের পাশাপাশি সব নারীই যেন নিজের কর্মক্ষতাকে শাণিত করেন এ পরামর্শ দিয়ে বীনা রাণী ত্রিপুরা বলেন, ‘শুধুমাত্র স্বামী অথবা অন্যদের ওপর নির্ভরতার বাইরে বিকল্প ক্ষেত্র থাকা উচিত। তবেই পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং মর্যাদার ভারসাম্য টিকে থাকবে। বুকে সাহস-সততা-শক্তি এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে কারো দিন কারো জন্য আটকে থাকে না বলেছেন সফল সংগ্রামী নারী বীনা রাণী ত্রিপুরা।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এমআরএম/এমএস