বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের শিকার হেলেন ছিলেন নারী ক্রিকেটার
![বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের শিকার হেলেন ছিলেন নারী ক্রিকেটার](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019February/patuakhali-20190307212257.jpg)
মাহ্ফুজা ইসলাম (হেলেন) একটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। পটুয়াখালীর বাল্যবিবাহ বন্ধ ও অসহায় নারীদের কর্মজীবি করতে অনুপ্রাণিত করেন তিনি। জেলার মির্জাগঞ্জে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে জেলা শহরে নারী উদ্যোক্তাদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছেন মাহফুজা। শহরের নিউ মার্কেটে প্রতিষ্ঠা করেছেন পায়রা ডিজিটাল সুপার সপ। শুধু সপই নয়, আছে মাছের খামার, বিভিন্ন ফলদ ও বনজ বাগান।
হেলেন জানান, বরিশালের আলেকান্দা এলাকার বাসিন্দা মৃত শাহ্জাহান আলী সরদারের ২য় মেয়ে তিনি। বরিশাল স্কুল থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি, বরিশাল কলেজ থেকে ১৯৮৬ সালে এইচএসসি ও একই কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৮২ সালে পারিবারিকভাবে মির্জাগঞ্জ এলাকার প্রবাসী মো. সফিকুল ইসলাম কায়সারের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তিন সন্তানের জননী তিনি।
তিনি জানান, বড় ছেলে ইটালি থেকে এমবিএ শেষ করে কাজ করছে। ছোট ছেলে বাংলাদেশ পর্যটন করর্পোরেশন ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে রাজধানীর লা মেরিডিয়ানে ইন্টার্নি করছে। মেয়ে বাংলাদেশ বিমানের বিমান বালা হিসেবে কর্মরত।
তিনি আরও জানান, ছোটবেলা থেকে ডানপিটে ছিলাম। নারী ক্রিকেটার ছিলাম। জাতীয় পর্যায়েও খেলাধুলা করেছেন। বাবা (শাহ্জাহান আলী সরদার) সামাজিক কাজ করতেন, তার থেকে অনুপ্রাণিত হতেন। আর ভাবতেন তিনি কখন বড় হবেন এবং মানুষের জন্য কাজ করবেন। ছোটবেলা থেকে মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বিয়ের পর থেকে দেখেছেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ এলাকার নারীরা অবহেলিত। এলাকার মানুষ কর্মক্ষম, কিছু বোঝে না। তখন থেকে নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করার চিন্তা হয়।
তিনি আরও জানান, আমি নিজেও বাল্য বিবাহের শিকার। একটা মেয়ে যদি বাল্যবিবাহের শিকার হয় তাহলে সে কীভাবে অন্যদের রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতাম। তখন আমি আমার শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ শুরু করি। কাজ করতে করতে এক পর্যায়ে উপলব্ধি করি এ কাজ করতে গেলে একটি সংস্থার প্রয়োজন। পরে পটুয়াখালী মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সিরিন আপার সহযোগিতায় ১৯৯৫ সালে শুকতারা মহিলা সংস্থা স্থাপন করি।
মাহ্ফুজা আরও জানান, ২০১১ সালে আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমি একজন মা-স্ত্রী হিসেবে ভালো ছিলাম। কিন্তু আমার অফিসের এক মেয়ে স্টাফের সঙ্গে স্বামী (কায়সার) সর্ম্পক করে বিবাহ করে। পরে আমিসহ আমার তিন সন্তান আলাদা হয়ে যাই। এরপর থেকে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই।
কান্নাকণ্ঠে তিনি জানান, আমি এখন একা থাকি। একা থাকলেও সুখে আছি। কারণ মানুষের জন্য বেশি কাজ করতে পারছি। দোয়া করি আমার মতো আর কোনো নারীর জীবনে এই কষ্ট যেন না নেমে আসে। নারী নির্যাতনের শিকার আমি, কষ্টের শিকারও আমি। যখন কাজ করতাম তখন ভাবতাম ছেলেরা দুটি বিবাহ কেন করে? তারতো বৌ-সন্তান-সংসার সব আছে। এখন বুঝি।
মাহ্ফুজা কাজের স্বীকৃতি নিয়ে জানান, ২০১৮ সালে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন দিবসের আয়োজনে স্টল নিয়ে সংস্থার প্রদর্শনী করে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী নারীদের জন্য এত এত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যা পৃথীবির অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়ক করেছে কীনা আমার জানা নেই? আমাদের নারীরা অনেক সাবলম্বী। যে নারীর ইচ্ছা আছে সে সাবলম্বী, যে নারীর ইচ্ছে নেই সে সাবলম্বী নয়। নারীর ইচ্ছা জাগিয়ে তোলার স্থানে আমিও আমার সংগঠন কাজ করছে।
মাহ্ফুজা জানান, ছয় বছর আগে পায়রা সুপার সপ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছি। যার মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থান হবে, যে জায়গায় কাজ করলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সপটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। সপটি আরও বড় করার স্বপ্ন রয়েছে। এছাড়া শহরের হেতালিয়া বাধঘাট এলাকায় কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ জেলা প্রশাসন থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকার তাকে এক একর জমি দান করেন। আর ওই এক একর জমির উপরে নিজে থাকার জন্য একটি ঘর, মাছের খামার, বিভিন্ন ফলদ ও বনজ বাগান করেছি।
তিনি জানান, লাভ আর ভালো লাগা আছে বলেই রাত দিন পরিশ্রমকে পরিশ্রম বলে মনে হয় না।
মাহ্ফুজার পরামর্শে শহরের পুরান বাজার এলাকায় ফ্যামিলি ফ্যাশন নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন মিনতী দত্ত। তিনি জানান, আপার সফলতা দেখে এই পথে নেমেছি। বিভিন্ন সময় পরামর্শের জন্য তার কাছে গেলে তিনি পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করেন। আমি মাত্র আড়াই হাজার টাকা দিয়ে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করি। তার পরামর্শে আজ মূলধন পাচঁ লাখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমএএস/পিআর