এই বয়সেও রিকশা চালাতে হচ্ছে ওদের
আসরের সময়। চারদিক থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের মধুর সুর ভেসে আসছে। ফায়ার সার্ভিস মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় রিকশার ওপরেই বসে আছেন বৃদ্ধ রিকশাচালক। বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর।
মধ্য বয়সী এক নারী এসে বললেন, চাচা যাবেন? উত্তরে রিকশাচালক বললেন, মা এখন আজান দিচ্ছে, নামাজেরও সময় হয়েছে, তাই এখন যাব না, আপনি অন্য রিকশা নিয়ে যান।
এ কথা শুনেই ধার্মিক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ জাগে এ প্রতিবেদকের।
নাম মো. আব্দুর রশিদ খান। বাসা ঝালকাঠি শহরতলির বিকনা এলাকায়। আব্দুর রশিদ জানান, ৫ মেয়ে ও ৩ ছেলেসন্তানের জনক তিনি। দুই মেয়ে ও এক ছেলে বিবাহিত। তারা নিজ সংসার নিয়ে আলাদা। বর্তমানে পরিবারে সদস্য সংখ্যা স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। পরিবারটির উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি একাই। এর মধ্যে বড় ছেলে আল-আমিন (২৮) শারীরিক প্রতিবন্ধী।
মেয়ে মরিয়ম আক্তার ঊর্মি ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। ৫ম শ্রেণিতে সে জিপিএ ৫ পেয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পায়। সমাজের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সহায়তায় তার পড়াশোনার খরচ অনেকটাই চলে। ছেলে আব্দুল্লাহ এবং অপর দুই মেয়ে বিকনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
আব্দুর রশিদ খান জানান, সকালে ফজরের নামাজ পড়ে রিকশা নিয়ে বের হই। যে যেদিকে ডাক দেয় সেদিকেই ছুটে যাই দু’পয়সা ইনকামের (আয়) জন্য। তবে জামায়াতে নামাজ পড়া কখনও ছাড়ি না। আজান দিলে মুয়াজ্জিন যখন বলে আল্লাহু আকবার, তখন মনে করি আল্লাহই মহান। তাই তার ডাকে সাড়া দিতে যাই। এ সময় যদি তার ডাকে সাড়া না দিয়ে টাকার জন্য যাত্রী বহন করি, তাহলে আল্লাহর চেয়েও টাকা বড় যাতে এমনটা প্রমাণ না হয়। অল্প আয় দিয়ে তিনি যেভাবে সংসার পরিচালনা করছেন তাতে আল্লাহর রহমত ও বরকত আছে বলেও সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিবন্ধী ছেলে আল-আমিনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি (আঃ রশিদ) বলেন, জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। ৭-৮ বছর বয়স হলেও দাঁড়াতে পারছে না, এমনটা দেখে আমরা হতাশ হয়ে যাই। এরপর এক কবিরাজের সন্ধান পেয়ে তার কাছ থেকে তেল এনে মালিশ করলে কিছুটা সুস্থ হয়। হাঁটাচলা করে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারে সে। ছেলের প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য এক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তিনি ৬ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু দিতে পারিনি। তাই কাজটা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস মোড়ের প্রতিবন্ধী (সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো) ভ্যারাইটিজ সামগ্রী বিক্রেতা ব্যবসায়ী কামাল হোসেন সিকদার জানান, রিকশাচালক রশিদ খান আমাদের কাছে অনেক বিশ্বস্ত। আমি ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার কাজে তারই সাহায্য নেই। অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে ও ভালোবাসে।
বৃদ্ধ রশিদ খানের পাশাপাশি এ প্রতিবেদকের কথা হয় প্রবীণ রিকশাচালক সুলতান হোসেন (৭২), আতোয়ার রহমান (৬৭), আবুল কালাম (৬০) এবং রুস্তম আলীর (৬৫) সঙ্গে।
সুলতান হোসেন সদর উপজেলার কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দা। ছয় সন্তানের জনক তিনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সংসারের খরচ বহন করতে রিকশা চালাচ্ছেন তিনি।
৬৭ বছর বয়সী আতোয়ার রহমানের বাড়ি মোরেলগঞ্জে হলেও বৈবাহিক সূত্রে প্রায় ৪০ বছর ধরে ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় বসবাস করছেন। তিন সন্তানের জনক হলেও তার বড় ছেলের বয়স ১৫ বছর। সে ওয়ার্কশপ শ্রমিক হিসেবে দৈনিক ২৫০ টাকা বেতনে চাকরি করে। বাকি এক ছেলে ও এক মেয়ে স্কুলে পড়ালেখা করে। সংসারের সবার খরচ জোগাতে রিকশা চালানোই তার একমাত্র ভরসা।
৬০ বছর বয়সী আবুল কালামের বাড়ি সদর উপজেলার চামটা গ্রামে। তারও দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানদের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ বহন করতে তিনি উপায় হিসেবেই রিকশা চালাচ্ছেন।
৬৫ বছর বয়সী রুস্তম আলীর বাড়ি সদর উপজেলার মহদিপুর গ্রামে। তিনি কিছু জমি বর্গা রেখে চাষাবাদ করেন। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং রাত ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রিকশা চালান তিনি। বাকি সময় বর্গা নেয়া জমির চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করেন। সাংসারিক জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক। রিকশা চালিয়েই বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণসহ সার্বিক অবলম্বন হিসেবে তিনি রিকশাচালানোকেই বেছে নিয়েছেন।
প্রবীণ পাঁচ রিকশাচালকই জানান, বৃদ্ধ বয়সে হলেও হালাল উপার্জনের একমাত্র উপায় হিসেবে রিকশা চালিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। রিকশার কদর আগের মতো নেই। তারপরও যা অর্জন হয় তা নিয়ে হালাল উপার্জনে আল্লাহর রহমত আছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।
আতিকুর রহমান/এমএএস/পিআর