স্ত্রীর শখ পূরণে কুমির হয়ে গেলেন স্বামী
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে মধুমতি নদী। এই নদীর একটি ঘাটের নাম ‘নদের চাঁদ’। ‘নদের চাঁদ’ একজন মানুষের নাম। ‘নদের চাঁদ’ জাদু বিদ্যা শিখে মানুষ থেকে কুমিরে পরিণত হয়েছিলেন।
পরে স্ত্রীর ভুলের কারণে আর মানুষ হতে পারেননি তিনি। মানুষ থেকে কুমির হওয়ার এই কিংবদন্তির কাহিনি আজো এলাকার মানুষের মুখে মুখে। ‘নদের চাঁদের’ এই কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা যাত্রা, নাটক এমনকি সিনেমা। তার নামে রয়েছে পুরো একটি মৌজা, গ্রাম, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অনেকদিন আগের কথা। উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামে অতি সাধারণ পরিবারে বাস করতেন ‘নদের চাঁদ’। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তার বাবা। ‘নদের চাঁদের’ তখনো জন্ম হয়নি। জন্মের আগেই ‘নদের চাঁদের’ বাবা গদাধর পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান। একমাত্র সন্তান বুকে নিয়ে দিন কাটে মায়ের। ‘নদের চাঁদ’ একসময় যৌবনে পা দেন। মা চান না বাবার মতো মাছ ধরতে নদীতে যাক ‘নদের চাঁদ’। তিনি চান ‘নদের চাঁদ’ বিয়ে করে সংসারী হোক, ক্ষেতখামারে কাজ করুক। কিন্তু সংসার বিবাগি ‘নদের চাঁদের’ ঘরে মন বসে না। গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে ‘নদের চাঁদ’ বেরিয়ে পড়েন অজানার পথে। ১০ বছর পর আবার বাড়ি ফিরে আসেন ‘নদের চাঁদ’। ততদিনে তার মা বৃদ্ধা হয়ে যান।
এবার ‘নদের চাঁদের’ মা তাকে বিয়ে দিলেন। স্ত্রীর ভালোবাসা তাকে ঘরে আটকে রাখলো। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল সুখ ও আনন্দে। দীর্ঘ ১০ বছর ‘নদের চাঁদের’ অন্তর্ধানের রহস্য খুলে বলেন স্ত্রী সরলার কাছে। ১০ বছর কামরূপে (আসাম) ছিলেন ‘নদের চাঁদ’। ওখানে এক নারীর কাছে জাদু বিদ্যা শেখেন ‘নদের চাঁদ’। এই জাদুর বলে কুমির হতে পারেন ‘নদের চাঁদ’ বলেন স্ত্রীকে। এমন কথা শুনে স্ত্রী সরলার শখ জাগে মনে। স্বামীকে কুমির হতে দেখবেন বলে বায়না ধরেন সরলা।
স্ত্রীর শখ পূরণের জন্য গভীর রাতে দুটি পাত্রের পানিতে মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেন ‘নদের চাঁদ’। সেই সঙ্গে স্ত্রী সরলাকে ‘নদের চাঁদ’ বলেন, একটি পাত্রের পানি গায়ে ছিটিয়ে দিলে কুমির হবে, অন্য পাত্রের পানি ছিটালে আবার মানুষ হবে ‘নদের চাঁদ’। এরপর এক পাত্রের পানি শরীরে ছিটিয়ে কুমির হয়ে যায় ‘নদের চাঁদ’। স্বামীকে কুমির হতে দেখে ভয়ে দৌড় দেন স্ত্রী সরলা। এ সময় সরলার পায়ের ধাক্কা লেগে অন্য পাত্রের পানি মাটিতে পড়ে যায়।
‘নদের চাঁদের’ বিষয়টি শাশুড়িকে জানান পুত্রবধূ। মা এসে দেখেন কুমির হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে ‘নদের চাঁদ’। স্ত্রী সরলার দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল ‘নদের চাঁদ’। ঘটনার তিনদিন পর কুমির ‘নদের চাঁদ’ মধুমতি নদীর পানিতে নেমে পড়ল। প্রতিদিন ‘নদের চাঁদের’ মা নদীর ঘাটে বসে চোখের জল ফেলেন। কয়েকদিন পর কামরূপ থেকে ‘নদের চাঁদের’ নারী উস্তাদকে খবর দিয়ে আনা হলো।
তিনি মধুমতি নদীর পাড়ে এসে ‘নদের চাঁদ’ বলে ডাক দিলেন। তখন কুমির ‘নদের চাঁদ’ মুখে ইলিশ মাছ নিয়ে উঠে এলো ডাঙায়। এ অবস্থা দেখে নারী উস্তাদ জানিয়ে দিলেন, ‘নদের চাঁদকে’ আর মানুষ করা যাবে না। কারণ ইতোমধ্যে আহার করে ফেলেছে কুমির ‘নদের চাঁদ’।’
এরপর মা ডাকলেই ‘নদের চাঁদ’ ঘাটে চলে আসত। মায়ের হাতের খাবার খেয়ে আবার নদীতে ফিরে যেত। কিছুদিন পর নদী দিয়ে একদল বণিক জাহাজযোগে যাওয়ার সময় চরে বিরাট একটি কুমির দেখতে পান। তারা কুমিরটি মেরে ফেলেন। পরে জানাজানি হলে লোকজন মৃত কুমিরটি উদ্ধার করে সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকার করেন।
স্ত্রীর শখ পূরণে ‘নদের চাঁদের’ কুমির হওয়ার বিষয়টি আজো মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার মানুষের মুখে মুখে। মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে একটু দূরে মধুমতি নদীর তীরে ‘নদের চাঁদ ঘাটটি’ এর জন্যই সবার কাছে পরিচিত।
একসময় এই ঘাটে স্টিমার ভিড়ত। ঘাটের পাশেই পাঁচুড়িয়া নামের একটি গ্রাম ছিল। পরে এটি ‘নদের চাঁদ’ গ্রাম নামে পরিচিতি পায়। ওই গ্রামের পর এখানে একটি ‘নদের চাঁদ’ বাজার ও ‘নদের চাঁদ’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এমন কাহিনির জন্য দূর-দুরন্ত থেকে অনেক মানুষ ‘নদের চাঁদ ঘাট’ দেখতে আসেন।
আরাফাত হোসেন/এএম/পিআর