গ্রামে যাচ্ছেন না চিকিৎসক, দুর্ভোগে রোগীরা
রাজশাহী জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় যাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অর্ধেক চিকিৎসক পদ খালি। যোগদান করলেও প্রেষণ ও সংযুক্তি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন কেউ কেউ।
আর এ কারণেই প্রান্তিক মানুষজন স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। অসচেতনতা ও দালালদের প্ররোচনায় যাচ্ছেন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটলেও মিলছে না বিচার।
গত বছরের ১২ নভেম্বর রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ বানেশ্বর এলাকায় পুষ্প ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মারা যান মর্জিনা বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধূ। নিহত মর্জিনা জেলার চারঘাট উপজেলার বালুদিয়ার গ্রামের হাফিজুর রহমানের স্ত্রী।
এর আগে ২০ অক্টোবর বাঘা উপজেলা সদরের জননী ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মারা যান আজমিরা বেগম (২৮) নামে এক প্রসূতি। তিনি ওই উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের চাঁদপুর ব্যাঙগাড়ি গ্রামের সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত মামলায় গড়ায়নি এসব ঘটনা।
স্থানীয়রা বলছেন, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই পাশের ক্লিনিক-হাসপাতালে যাচ্ছেন। এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা দিচ্ছেন স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসক।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুর্গম এলাকা চরআষাড়িয়াদহে রয়েছে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে একজন সহকারী সার্জনের পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য এই পদ। একই দশা উপজেলার আরও ১০ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের। যদিও কাগজে কলমে বালিয়াঘাটা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডা. লায়লা রাজ্জাক এবং বাসুদেবপুর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডা. তৌহিদা সাবরিনকে কর্মরত দেখানো হয়েছে।
এদের মধ্যে ডা. তৌহিদা রাজশাহী নগরীর পুলিশ হাসপাতালে প্রেষণে নিযুক্ত। আর ডা. লায়লা সংযুক্ত মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজে।
জেলা সিভিল সার্জন দফতরের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী, চিকিৎসক সংকট জেলার ৯ উপজেলার ৭৬ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেই। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে সহকারী সার্জনের পদ রয়েছে। এর মধ্যে পবা উপজেলার ৯ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৪টিতে, মোহনপুরের ৬ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৩টিতে, তানোরের ৮ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৮টিতে, গোদাগাড়ীর ১১ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৯টিতে, বাগমারার ১৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ১৭টিতে, দুর্গাপুরের ৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে, চারঘাটের ৬ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৬টিতে, পুঠিয়ায় ৭ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৭টিতে এবং বাঘার ৫ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৩টিতেই চিকিৎসক নেই।
কেবল ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রই নয়, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও চিকিৎসক সংকট। জেলার বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ রয়েছে সবমিলিয়ে ২২টি। এখানে নেই জরুরি মেডিকেল অফিসার ও মেডিকেল অফিসার। শূন্য রয়েছে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন, অ্যানেসথেসিয়া, চক্ষু, হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন এবং অর্থপেডিক বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট পদও।
জেলার পবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন একমাত্র আবাসিক মেডিকেল অফিসার। এর বাইরে নয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই পদে কোনো চিকিৎসক নেই। নগরীর উপকণ্ঠ হওয়ায় পবা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক পদ শূন্য নেই। তবে এখানে রোগীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পুঠিয়ায় ৬, চারঘাটে ৬, দুর্গাপুরে ৭, বাগমারায় ৪, তানোরে ৭, মোহনপুর ও গোদাগাড়ীতে একজন করে চিকিৎসকের পদ শূন্য। আর এ নিয়েই সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ গোদাগাড়ীতে রয়েছে ৩১ শয্যা হাসপাতাল। প্রতিদিনই এখানে ঘটছে ছোট বড় সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ জরুরি অস্ত্রপচারের জন্য এই হাসপাতালে নেই সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ। ৯ চিকিৎসক পদ থাকলেও এখানে আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ শূন্য আরও ৫ পদ।
এখানকার হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সংকট রয়েছে নার্সের। জেলায় নার্সিং সুপারভাইজারের মঞ্জুরিকৃত ৭ পদের বিপরীতে কর্মরত ৫ জন। এছাড়া ১৮৬ পদের বিপরীতে সিনিয়র স্টাফ নার্স কর্মরত ১৭১ জন। আর ১০ পদে সহকারী নার্সের বিপরীতে কর্মরত মাত্র একজন।
চিকিৎসক সংকটে সেবা কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. সঞ্জিত কুমার সাহা। তিনি বলেন, যে চিকিৎসক কর্মরত আছেন, তারা সাধ্যমত সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে চিকিৎসক সংকট থাকবে না। চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না বলেও স্বীকার করেন সিভিল সার্জন।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর/এমকেএইচ