রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছাড়ার অপচেষ্টা থামছে না
নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি প্রয়োজনমতো জীবন ধারণের রসদ সরবরাহের পরও অভাবের কথা বলে কাজের সন্ধানে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মক্ষেত্র খোঁজার পাশাপাশি সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতেও চেষ্টা চালাচ্ছেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা।
গত কয়েক দিনে উখিয়া-টেকনাফ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার সাগরতীর থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশ রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছেন অভিযানকারীরা। এদের মাঝে অধিকাংশই ১৬ থেকে ২৫ বছরের তরুণী।
এ সময় কয়েকজন দালালকেও গ্রেফতার করেছে আইন শৃংখলাবাহিনী। এ ব্যাপারে মামলা হলেও রোধ হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর অপচেষ্টা।
এদিকে আশ্রিত রোহিঙ্গার তুলনায় নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতি অপ্রতুল হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ক্যাম্প এলাকায় দায়িত্বরত চেকপোস্ট সংশ্লিষ্টরা। আবার রোহিঙ্গাদের ভাষা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে স্থানীয়দের সঙ্গে অনেক মিল থাকায় কৌশলে ক্যাম্পের চেকপোস্ট ছাড়ছে রোহিঙ্গারা।
আইনশৃংখলা বাহিনীর সূত্র মতে, সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের ফজল মার্কেট এলাকার হোটেল রাজমনিতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে অপেক্ষারত ১২ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে র্যাব-৭। এ সময় মানবপাচারকারী চক্রের ২ সদস্যকেও গ্রেফতার করা হয়।
বৃহস্পতিবার উখিয়া উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী গাড়ি ও পথচারীর বেশ ধরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়ে পালানো ৮৭ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। আটকদের থানা হেফাজতে রাখলে তাদের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে।
ওসির মতে, প্রতিদিন অগনিত রোহিঙ্গা পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। এসব রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ত্যাগ করে মালয়েশিয়া অথবা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে একদিন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই পুলিশ রাতদিন পরিশ্রম করে রোহিঙ্গাদের আটক করছে।
ক্যাম্প সূত্র মতে, উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা অনুপাতে সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণে বসানো পুলিশের চেকপোস্টে লোকবল সঙ্কট রয়েছে। সীমিত সংখ্যক চেকপোস্ট ও কম লোকবলের কারণে রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
চেকপোস্টে দায়িত্বরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিমত, রোহিঙ্গাদের ভাষাগত দিক, চালচলন, পোশাক পরিচ্ছদ, আচার আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে মিল থাকায় ভিন্ন জেলার অধিবাসী আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় ও রোহিঙ্গা শনাক্তে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। ফলে তাদের ফাঁকি দিয়ে কৌশলে ক্যাম্প ত্যাগ করছে রোহিঙ্গারা।
ক্যাম্প ত্যাগ করা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, এনজিও কর্তৃক দেয়া সহায়তায় ভরণ-পোষণের চাহিদা মিটছে না। তাই একটু স্বাচ্ছন্দে থাকার আশায় কাজের সন্ধানে তারা ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
আর তরুণীদের মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা সম্পর্কে তারা জানান, বিয়ের বয়স হলেও অভিভাবকহীন কোনো মেয়েকে সহজে কেউ বিয়ে করছে না। তাছাড়া যৌতুক না পেলে বিয়ে করতে চাচ্ছে না স্বজাতিরা। এসব কারণে মালয়েশিয়ায় বিনাযৌতুকে বিয়ের আশায় ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে পালানোর চেষ্টা করছেন তারা।
উখিয়া পুলিশের হাতে আটক রোহিঙ্গা সেলিম উল্লাহ জানান, ৭ সদস্য নিয়ে তার পরিবার। খাদ্য সহায়তা কম দেয়ায় ঠিকভাবে খেতে পারছেন না। তাই কাজের সন্ধানে কুতুপালং ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, অনেক রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় স্থায়ীভাবে বাস করছে। এদের অনেকে ৯০’র দশক বা তার পরে এসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবাস গেড়েছে। অনেকে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও গার্মেন্টসে চাকরি করছেন। ক্যাম্পে অবস্থানকারী অনেকেরে স্বজনও রয়েছেন এদের তালিকায়। তাদের পরামর্শে ক্যাম্প ছেড়ে সেসব এলাকায় গিয়ে চাকরির জন্য তারা পালিয়ে যাচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে পালাতে না পারে সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদ জামান চৌধুরী বলেন, অনেক সময় সহানুভুতি নেয়ার আশায় রোহিঙ্গারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। আবার তারা মালয়েশিয়াসহ নানা উন্নত রাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার আশায় দালালদের প্রলোভনে পড়ে অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। এটি রোধে কঠোরভাবে সতর্ক রয়েছে বিজিবি।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো.আবুল কালাম বলেন, তালিকাভুক্ত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণ পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সবাই দেখে থাকবেন, রোহিঙ্গাদের দেয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই তাদের প্রয়োজন অনুপাতে ভোগ্যপণ্য না পাওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা।
পূর্বে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশি সেজে প্রবাসে গেছেন তাদের মতো সুযোগ পাওয়া যায় কিনা বা দালালদের আশ্বস্ত করা বাণী শুনে হয়তো তারা ক্যাম্প ছাড়ছে। মানবিক আশ্রয় দেয়ার কারণে সরকার তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ করছে। এটার সুযোগ নিলে প্রশাসনকে আরো কঠোরতা দেখাতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/এফএ/এমএস