যশোরের বর্ষীয়ান রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রোববার বিকেল পাঁচটার কিছু সময় পর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার ছোট ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেশ কিছুদিন আগে তাকে অ্যাপোলোতে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিকস, কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুর খবর যশোরে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন ও নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে দলের নেতাকর্মীরা তরিকুল ইসলামের যশোর শহরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডস্থ বাড়িতে জড়ো হন। গোটা জেলা জুড়েই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
পারিবারিক পরিচিতি :
বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্দুল আজিজ ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। তরিকুল ইসলাম দুই পুত্র সন্তানের জনক। স্ত্রী নার্গিস বেগম তার অন্যতম রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। তিনি যশোর সরকারি সিটি কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান।
শিক্ষাজীবন :
১৯৫৩ সালে তিনি যশোর জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। একটানা আট বছর শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৬১ সালে তিনি এই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে তিনি যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে তিনি অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজনৈতিক জীবন :
পেশাগতভাবে তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি।
বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহুবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতনের শিকার হন। যশোর এম এম কলেজে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিতে গিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এম এন এ মি আহম্মদ আলী সর্দার কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় তাকে বেশ কিছুদিন কারাবরণ করতে হয়।
১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্যে তাকে রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করতে হয়। সাবেক পাকিস্তান আমল ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলে প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হন এবং বেশ কিছুদিন হাজতবাস করেন।
জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম একজন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। ভাসানী আহুত ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে নয়মাস ভারতে অবস্থান করেন। ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়ের পর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
বাকশাল আমলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রাখার কারণে তরিকুল ইসলাম নির্যাতনের শিকার হন ও কারাবরণ করেন। ১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তরিকুল ইসলাম তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ফ্রন্টের হ্যাঁ/না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। মরহুম মশিউর যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী) বিলুপ্ত হলে তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির গঠনে ভূমিকা রাখেন।
যশোর সদর নির্বাচনী এলাকা (যশোর-৩) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময়ে তিনি জাতীয়তাবাদী দলের জেলা আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮২ সালের ৫ মার্চ তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি এরশাদ কর্তৃক কারারুদ্ধ হন এবং দীর্ঘ তিন মাস অজ্ঞাতস্থানে আটক থাকেন। অতঃপর তথাকথিত এরশাদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থাকেন এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৬ সালে তাকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ সময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৯০ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর ১৯৯১ এর সংসদ নির্বাচনে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। ১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে তরিকুল ইসলাম সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ সময়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি প্রায় ৪০ হাজার ভোটের ব্যবধানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আলী রেজা রাজুকে পরাজিত করে যশোর-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপির মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে তিনি সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
যশোর উন্নয়নে অবদান
তরিকুল ইসলামকে যশোরের উন্নয়নের রূপকার বলা হয়। যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট, বিভাগীয় কাস্টমস অফিস, বেনাপোল স্থলবন্দরসহ অনেক অর্জনের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি।
সামাজিক কর্মকাণ্ড
তরিকুল ইসলাম যশোর সরকারি সিটি কলেজ পরিচালনা পরিষদের নির্বাহী সদস্য, যশোর ইনস্টিটিউটের সহকারী সম্পাদক, যশোরের সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জাগরণী চক্র’ এর সভাপতি, কিংশুক সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান উপদেষ্টা ও যশোর ক্লাবের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে আধুনিকীকরণে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
মিলন রহমান/এমএএস/পিআর