লাঙ্গলের দুর্গে হানা দিতে মরিয়া নৌকা
দেশে জাতীয় পার্টির দুর্গ খ্যাত কুড়িগ্রামের ৪টি আসন। আর এই দুর্গে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে হানা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। এখানকার সম্ভাব্য প্রার্থীরা একদিকে ছুটছেন ভোটারদের কাছে অপরদিকে মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে চালাচ্ছেন জোর লবিং। আর এসবের মধ্যে নির্বাচনে আসার সম্ভাবনাই ঝুলে আছে বিএনপির।
কুড়িগ্রামের ৪টি আসনে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টির ১৫ প্রার্থী, আওয়ামী লীগের ৭ প্রার্থী, বিএনপির ২ এবং অন্যান্য দল ৪ প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
কুড়িগ্রাম-১
কুড়িগ্রাম-১ আসন গঠিত হয়েছে দু’টি উপজেলা নিয়ে। এরমধ্যে নাগেশরী উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন এবং ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয় এই আসনটি। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬১ হাজার ২৭২ জন।
এই আসনে ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামসুল হক চৌধুরী নির্বাচিত হোন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির হেভিয়েট প্রার্থী না থাকায় জাতীয় পার্টির দখলে চলে যায় আসনটি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে নির্বাচিত হন আখম সহিদুল ইসলাম। এছাড়া টানা ৪ বার এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। তাকে হটাতে এখন মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, শিল্পপতি গোলাম মোস্তফা, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আছলাম হোসেন সওদাগর, নাগেশ্বরী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাম্মেল হক প্রধান, কৃষক নেতা মজিবর রহমান বীরবল ও তার ছেলে মাজহারুল ইসলাম, ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুন্নবী চৌধুরী খোকন, মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পপতি আখতারুজ্জামান মন্ডল ও মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-১ আসনে নির্বাচনে শিল্পপতি গোলাম মোস্তফা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে মহাজোটের কারণে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। ২০১৪ সালে অবশ্য প্রার্থী বদল করে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আছলাম হোসেন সওদাগরকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু একই কারণে আসনটি ছেড়ে দিতে হয় জাতীয় পার্টির প্রার্থী একেএম মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে।
কুড়িগ্রাম-২
কুড়িগ্রাম-২ আসনটি ৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। আসনটি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার একটি পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়ন, রাজারহাটে ৭টি ইউনিয়ন এবং ফুলবাড়ি উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৩৫ জন। সদর আসন হওয়ায় সব দলের কাছেই গুরুত্ব বহন করে এই আসনটি।
এখান থেকে একবারই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিয়া উদ্দিন আহমদ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে তাজুল ইসলাম চৌধুরী নির্বাচিত হন। পরে বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত হন তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
২০০৮ সালে আবারও তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচন করেন। তবে সেবার জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। পরে ২০০৮ সালে এরশাদের ছেড়ে দেয়া আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাফর আলীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তাজুল ইসলাম চৌধুরী। পরবর্তীতে পুনরায় জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন তিনি এবং আওয়ামী লীগ আসনটি ছেড়ে দিলে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে আসনটিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে জোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছেন জাফর আলী। এছাড়াও এই আসন থেকে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন- সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আ.ম.সা.আ. আমিন (অব.), জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম মঞ্জু মন্ডল, সহ-সভাপতি চাষী করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন মঞ্জু, পিপি অ্যাড. আব্রাহাম লিংকন, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক অ্যাড. রুহুল আমিন দুলাল ও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. হামিদুল হক খন্দকারে
এদিকে হঠাৎ জেলা আওয়মী লীগের সহ-সভাপতি পনির উদ্দিন আহমদের নাটকীয়ভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগদানের ফলে নির্বাচনের সমিকরণ অনেকটাই জটিল হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।
অপরদিকে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেতে তাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাই সফিকুল ইসলাম ও মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালামের নামও শোনা যাচ্ছে।
কুড়িগ্রাম-৩
কুড়িগ্রাম-৩ আসনটি একটি মাত্র উপজেলা উলিপুর নিয়ে গঠিত। এখানে একটি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন রয়েছে। মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৩ হাজার ১৮০ জন।
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের দু’জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কানাই লাল সরকার এবং ১৯৯১ সালে আমজাদ হোসেন তালুকদার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে চলে যায়। পরে ১৯৭৯ সালে একেএম মাইদুল ইসলাম বিএনপি ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে মতিউর রহমান নির্বাচিত হয়।
এরই মধ্যে একেএম মাইদুল ইসলাম আবারও জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে ভোটে এবং ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন।
চলতি বছর তিনি মারা গেলে এই আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ডা. আক্কাছ আলী সরকার আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মতিনকে পরাজিত করেন।
এই আসন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য লবিং করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতি শিউলী, সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন তালুকদার ও তার ছেলে সাজেদুর রহমান তালুকদার ও অধ্যাপক এমএ মতিন।
২০০৮ সালে অধ্যক্ষ নাসিমা বানু ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে মতি শিউলি দলের মনোনয়ন পেলেও মহাজোটের কারণে মাঈদুল ইসলামকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। এবারও জোটগত কারণে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিতে হয় কিনা এ নিয়ে দলের নেতা কর্মীরা শঙ্কিত।
তবে রংপুরের শিল্পপতি সনিক প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যন ডা. আক্কাছ আলী উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এরশাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে আগামী নির্বাচনেও ডা. আক্কাছ আলীই দলের প্রার্থী হচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম-৪
কুড়িগ্রাম-৪ আসনটি ৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে। চিলমারীর ৬টি, রৌমারীর ৬টি এবং রাজিবপুরের ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসন। আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন ১৯৭৩ সালে, ২০০৮ সালে জাকির হোসেন এবং ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হক ও ১৯৮৬ সালে ন্যাপের প্রার্থী নাজিমউদ্দৌলা নির্বাচিত হয়। পরে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল নির্বাচনে হেট্রিক করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম হোসেন।
শেষমেশ ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির একাশং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি (বাইসাইকেল প্রতীক) প্রার্থী রুহুল আমিন।
এই আসন থেকে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশায় যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, আওয়ামী লীগের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকার বীর বিক্রম, রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য জাকির হোসেন, রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মিনু, রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাড. শেখ জাহাঙ্গীর আলম, চর শৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান কে.এম ফজলুল হক, চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রহিমুজ্জামান সুমন, রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী, রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিউল আলম ও অধ্যক্ষ ফজলুল হক মনি।
কুড়িগ্রামে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পর শক্তিশালী দল ইসলামী আন্দোলন। তারাও ৪টি আসনেই প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম-১ আসনে জাসদের আনছার আলী ইনু, ইসলামী আন্দোলনের আনছার আলী রয়েল ও আব্দুর রহমান, কুড়িগ্রাম-২ আসনে ইসলামী আন্দোলনের সাবেক সেক্রেটারি মাওলানা মোকছেদুর রহমান, জাসদের এমদাদুল হক এমদাদ, ছলিমুল্লাহ ছলি, কুড়িগ্রাম-৪ আসন থেকে বাসদের আবুল বাশার মঞ্জুসহ কয়েকটি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা পোস্টার ও বিলবোর্ড দিয়ে প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা জানিয়েছেন
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম মঞ্জু মন্ডল বলেন, দলের সভানেত্রী নির্বাচনের স্বার্থে যে সিদ্ধান্তই নেবেন আমরা জেলা আওয়ামী লীগ একত্রিত হয়েই কাজ করব। তবে আমরা আসা করি নেত্রী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার স্বার্থে হলেও অতন্ত কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাফর আলীকে মনোনয়ন দেবেন।
জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব রেজাউল করিম রেজা জানান, জেলা জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো কোন্দল না থাকায় দলের চেয়ারম্যান যাকেই মনোনয়ন দিক ৪টি আসনেই জাতীয় পার্টি জয়লাভ করবে।
এছাড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা জানান, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি আমরা। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কুড়িগ্রামের ৪টি আসনেই বিপুল ভোটে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত হবে।
এফএ/এমএস