বিএনপির ভয় জামায়াত নিয়ে নৌকার টিকিটের লম্বা লাইন
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে নৌকার টিকিট পেতে নেতাদের লম্বা লাইন পড়েছে। বিপরীতে ধানের শীষের জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা অর্ধেক। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে ৮ জন মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে থাকলেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা ৪। তবে জোটশরীক জামায়াতের প্রার্থী থাকায় দুর্ভাবনা আছে বিএনপি নেতাদের। এছাড়া জাতীয়পার্টির তিন জন প্রার্থীর নামও শোনা যাচ্ছে এখানে।
যশোরের চৌগাছার ১১ ও ঝিকরগাছার ১১টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-২ সংসদীয় আসন। গত দশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাঁচবার, জামায়াত তিনবার ও বিএনপি-জাতীয় পার্টির প্রার্থী একবার করে বিজয়ী হয়েছেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যশোর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্তত ৮ জন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। এরা হলেন, বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলী রায়হান, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আইনজীবী এবিএম আহসানুল হক আহসান, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম হাবিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় যুবলীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও উপশহর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হারুণ-অর রশিদ।
আর বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ও ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা নাজমুল মুন্নি, যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসহক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ও চৌগাছা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলাম।
আলোচনায় রয়েছেন জামায়াতের সাবেক এমপি আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হুসাইন। যিনি ২০০১’র নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির নুরুল কদর, বিএম সেলিম রেজা ও মুফতি ফিরোজ শাহ্’র নামও বলছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
এই আসনে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আবুল ইসলাম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলামের বাবা। ১৯৭৯ সালে বিএনপির বদরুল আলা, ১৯৮৬ সালে জামায়াতের মকবুল হোসেন, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মীর শাহাদাতুর রহমান, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের মকবুল হোসেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ২০০১ সালে জামায়াতের আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হুসাইন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনিরুল ইসলাম নির্বাচিত হন।
তবে ২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াত জোট নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগের ১১ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মনিরুল ইসলামের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
এদিকে, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় প্রার্থীদের মধ্যে গণসংযোগে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই মাঠে-ময়দানে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশের মতো ব্যতিক্রমী কর্মসূচি করে চলেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনির।
তিনি বলেন, আগের এমপিরা এলাকার পরিবর্তে ঢাকায় পড়ে থাকতেন। আমি নির্বাচনী এলাকায় পড়ে থাকি। মানুষের কথা শুনি। সমাধানের চেষ্টা করি। ফলে মনোনয়ন না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলের একাধিক ব্যক্তি মনোনয়ন চাইতেন পারেন। এটা কোনো বিষয় নয়। নৌকার মনোনয়ন পেলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়বেন বলে আশাবাদ তার।
আর দুই বছর ধরে নির্বাচনী এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প ও গণসংযোগ করছেন মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন। শো-ডাউন করেছেন আনোয়ার হোসেন। আলী রায়হান, আহসানুল হক ও হারুণ-অর-রশিদ কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। আর চৌগাছা এলাকায় তৎপর রয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম হাবিবুর রহমান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সম্প্রতি মাঠে নিয়মিত গণসংযোগ করে চলেছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তার এই গণসংযোগে এক ধরনের নির্বাচনী আবহাওয়া তৈরি হয়েছে ঝিকরগাছা ও চৌগাছায়। তিনি দলের ‘আদি’ নেতাদের বাসায় যাচ্ছেন। প্রবীণদের খোঁজ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
এদিকে রফিকুল ইসলাম মাঠে নামার পর কর্মীদের একাংশে ফুরফুরে মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। যারা বর্তমান এমপি মনিরুল ইসলামকে পছন্দ করেন না। কিংবা মনিরুলের অনুসারীদের হাতে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত তারা রফিকুল ইসলামকে আস্থার প্রতীক মনে করছেন। এমন তথ্য দিয়েছেন গদখালী বাজারের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানসহ অনেকে। তবে রফিকুল ইসলাম ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ভূমিকার কারণে দল তাকে এখন কতটা মূল্যায়ন করবে তা নিয়ে তৃণমূলের একাংশের মাঝে সংশয় রয়েছে।
আর বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেত্রী ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান এবং বিএনপির আলোচিত নেতা নিহত নামজুল ইসলামের স্ত্রী সাবিরা নাজমুল মুন্নী, যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসহক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ও চৌগাছা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলাম।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, চৌগাছা উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে আছি। ধানের শীষের মনোনয়ন নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ পেলে দুই উপজেলার মানুষ বিপুল ভোটে তাকে বিজয়ী করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আর সাবিরা নাজমুল মুন্নীর সমর্থকরা বলছেন, মুন্নী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে এলাকার মানুষের মন জয় করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের সংসদ নির্বাচনেও মানুষ নিরঙ্কুশভাবে ভোট দিয়ে তাকে জয়ী করবে।
এদিকে, এই আসনে জামায়াতের কিছু রিজার্ভ ভোট থাকায় তাদের ভরসায় জোটের মনোনয়ন চাইবেন সাবেক এমপি আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হুসাইন। যদিও নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। জামায়াত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় কৌশলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে জোটের আসন ভাগাভাগির হিসেব-নিকেশে বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তবে এবার বিএনপির প্রার্থীরা জামায়াতকে আসনটি ছাড় দিতে নারাজ।
মিলন রহমান/এমএএস/এমএস