চোখের পানি মোছেন আর কাঁদেন মেঘলা
খোলা আকাশের নিচে থালা-বাসন ছাই দিয়ে মাজতে ছিলেন মেঘলা বেগম। ফাঁকে ফাঁকে কাপড় দিয়ে চোখের পানি মোছেন। কাছে যেতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি।
শরীয়তপুরে পদ্মা নদীর ভাঙনে সব কিছু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন মেঘলা বেগম। নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের চর জুজিরা গ্রামের শহীদুল ইসলামের স্ত্রী তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেঘলা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। স্বামী-সন্তান নিয়ে একখণ্ড জমিতে সুখেই কাটছিল আমাদের সংসার। হঠাৎ একদিন আমাদের ঘরবাড়ি পদ্মার গর্ভে চলে যায়। দুঃখ-কষ্ট নিয়ে সেখান থেকে কেদারপুর লস্কর বাড়ির বাগানে আশ্রয় নিই। সেই বাগানও নদীগর্ভে চলে যায়। এখন পরিবার নিয়ে কেদারপুর মিয়া বাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছি।
মেঘলা বেগম বলেন, খোলা আকাশের নিচে থাকতে অনেক কষ্ট হয়। আগে তিনবেলা খেতাম এখন এক বেলা খেয়ে আছি। দিনে রোদে পুুড়ি আর রাতে বৃষ্টিতে ভিজি। রাতে পোকা-মশা কামড়ায়। বিদ্যুৎ নাই, পানি নাই। চোরের ভয়ে রাত জেগে থাকতে হয়। আমার দুই বছরের একটি সন্তান আছে। এখানে কোনো বিছানা নেই। অন্ধকারে ছেলেকে নিয়ে মাটিতে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, স্বামী কৃষি কাজ করত। ভাই রিকশা চালাতো। এখন রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় কাজ বন্ধ। কষ্টে আর দিন কাটে না। এত কষ্ট তার ওপর আবার কিস্তি। প্রতিদিন স্যারেরা কিস্তির টাকার জন্য আসে। কিস্তি না দিলে খারাপ কথা কয়। কিছু দিন পরে যদি কিস্তিগুলো নিতো তাহলে ভালো হতো। সরকার যদি সাহায্য করত আমরা বাঁচতে পারতাম।
কেদারপুর মিয়া বাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে মেঘলা বেগমের পরিবারের মতো বসবাস আর ১০ পরিবারের। বসতভিটা হারিয়ে মানুষগুলোর মাঝে এখন হাহাকার। দুই সপ্তাহ আগে নিজেদের বসতবাড়িতে থাকতেন তারা। গত ৬ সেপ্টেম্বর পদ্মার ভাঙন শুরু হলে ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কোনরকমে ঘরের আসবাবপত্র সরাতে পারলেও হারিয়ে যায় ভিটেমাটি। সব হারানোর পর অন্যের জমিতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে পরিবারগুলো।
বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথার ওপর কাজগ-কাপড় দিয়ে সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে পরিবারগুলো। গত ১০ দিনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি পারিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু ৩০ কেজি চালে অনেকের সংসার চলছে না।
নদী ভাঙনকবলিত রাশ মনি দাস বলেন, মূলফৎগঞ্জ বাজারে আমাদের মাঠার দোকান ছিল। এক মাস সাত দিন হলো আমাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট নদীতে চলে যায়। সব হারিয়ে কেদারপুর মিয়া বাড়ির মাঠে আশ্রয় নিয়েছি। আমার দুটি ছেলে রয়েছে। তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে পারছি না। তার ওপর আবার কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমরা খাইতে পাই না, কিস্তি দিমু কিভাবে। প্রতিদিন কিস্তির টাকার জন্য স্যারেরা এসে চাপ দিচ্ছে। এ সময় কিস্তিটা বন্ধ রাখলে আমরা বাঁচতাম।
মৃত আব্দুল বারেক গাজির স্ত্রী মাসুদা বেগম (৬০) বলেন, কেদারপুর চর জুজিরা গ্রামে ২১ শতাংশ জমির ছিল আমার। ছয় বছর ধরে সেই বাড়িতে ছিলাম। নদী নিয়ে গেছে সেই জমি ও বাড়ি। এখন অনেক অভাব, টাকার জন্য কিছু খেতে পারছি না, ঘর তুলতে পারছি না। একটি ছেলে তাও প্রতিবন্ধী। কয়েকদিন ধরে ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আল্লাহ ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নাই। খোলা মাঠে থাকি, রাতে চোর আসে। কোথায় যাব বুঝতেছি না।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, আগামী পাঁচ মাস নদী ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের কাছ থেকে কিস্তি আদায় বন্ধ রাখবে এনজিও, ব্যাংক ও সমবায় সমিতি।
কিন্তু স্থানীয়রা জানায়, ব্যুরো বাংলা, আশা, গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক ও সমবায় সমিতি ভাঙন কবলিতদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা আদায়ে প্রতিদিন চাপ প্রয়োগ করছে।
স্থানীয় এনজিও, ব্যাংক, সমবায় সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিস্তির টাকা বন্ধ রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, মন্ত্রণালয় থেকে কোনো চিঠি পাননি তারা। তবে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কিস্তি আপাতত বন্ধ রাখতে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন তারা।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, যেসব ব্যবসায়ী নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ক্ষতি পোষাতে কাজ করবে সরকার। প্রতিটি ব্যাংক, বীমা, সমবায় সমিতি ও এনজিওকে চিঠি দিয়েছেন ডিসি। আগামী পাঁচ মাস ভাঙনকবলিত এলাকার মানুুষের কাছ থেকে কিস্তির টাকা আদায় কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য। ইতোমধ্যে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে চাল, শুকনা খাবার ও টিন বিতরণ করা হয়েছে।
মো. ছগির হোসেন/এএম/এমএস