প্রাণ বাঁচানোর উপকরণ নেই বালাসী-বাহাদুরাবাদের নৌকাগুলোতে
নৌকাগুলোতে জীবন বাঁচানোর কোনো উপকরণ না থাকায় যমুনা নদীর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট, ফুলছড়ি ঘাট, হাজিরহাট ও সাঘাটা উপজেলা বাজারের নৌঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ফুটানির বাজার নৌ-রুটে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। শুধু এ নৌ-রুটেই নয় গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র নদসহ তিস্তা ও যমুনা নদীর ১৬৫টি চরের প্রায় ৪ লাখ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে এসব নদীপথেই।
নৌপথে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও জীবন বাঁচানোর জন্য নৌকাগুলোতে নেই পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া। শুধু তাই নয়, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে নৌকাগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পলিথিন, প্রচণ্ড রোদে ছায়া পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা। এ ছাড়া যাতায়াতে অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নৌযাত্রীরা।
বালাসী ও বাহাদুরাবাদ ঘাটের ইজারাদার, নৌকাচালক এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালাসীঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে যাতায়াতে ডিজেল লাগে ১২ লিটার আর ফুলছড়ি ঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ যাতায়াতে লাগে ১০ লিটার। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬৭ টাকা করে। গাইবান্ধার নৌ-ঘাটগুলো থেকে বাহাদুরাবাদ ফুটানির বাজার ও বাহাদুরাবাদ ফুটানির বাজার থেকে গাইবান্ধার নৌ-ঘাটগুলোর ভাড়া ১০০ টাকা করে। ৬০ থেকে ৭০ হাত নৌকায় ১০০ থেকে ১৫০ জন করে যাত্রী পারাপার করা যায়। প্রতিদিন এসব নৌপথে চলাচল করে তিন শতাধিক মানুষ আর মাসে ১০ সহস্রাধিক।
বালাসীঘাট থেকে চারবার, হাজীরহাট, ফুলছড়ি ঘাট ও সাঘাটা উপজেলা বাজারের নৌঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ফুটানির বাজারে একবার করে যাতায়াতে মোট ১৪ বার নৌকা চলাচল করে। বালাসীঘাট থেকে ফুটানির বাজারের উদ্দেশে সকাল ১০টা, দুপুর ১২টা ও ২টা এবং বিকেল ৪টায় আর ফুটানির বাজার থেকে বালাসীঘাটের উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে ৮টা, সাড়ে ১১টা, দেড়টা ও আড়াইটায় নৌকা ছাড়ে। অল্প সময়ে ও অল্প খরচে ফুটানির বাজার থেকে অটোরিকসাযোগে দেওয়ানগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন দিয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায় ঢাকায়। নৌকাভাড়াসহ গাইবান্ধার নৌঘাটগুলো থেকে ঢাকায় ট্রেনে যেতে খরচ হয় মাত্র ২১৫ থেকে ২৯৫ টাকা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সাঁতার জানলেও নদীতে বা সমুদ্রে নৌযান ভ্রমণে গেলে, সাগর-হাওর-লেক বা ঝরণা এলাকায় নামলে বা সাঁতার কাটতে গেলে, বন্যা বা পানির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গেলে, খরস্রোতা কোথাও গেলে ও ঝুঁকিপূর্ণ নৌরুটে যাতায়াতের সময় সাঁতার জানলেও যাত্রী ও চালকসহ সকলের শরীরে লাইফ জ্যাকেট থাকতে হবে।
গত ২০ আগস্ট সরেজমিনে সকাল ১০টার নৌকায় বালাসীঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ও দুপুর ২টায় বাহাদুরাবাদ থেকে ফুলছড়ি ঘাট নৌ-রুটে যাতায়াত করে দেখা গেছে, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে নৌকায় ছিল না পর্যাপ্ত পলিথিন। পরে যাত্রীদের চাপে আরেকটি নৌকা থেকে একটি পলিথিন নিয়ে আসলেন নৌচালক। চালক ইঞ্জিন চালু করার পরে নৌকায় লাইফ বয়া না নেওয়ায় চালককে ধমক দিয়ে দুইটি লাইফ বয়া এনে নৌকায় ফেলে দিলেন ঘাটের ইজারাদারের এক লোক।
ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেরি হওয়ায় সকাল সাড়ে ১০টার কিছুটা পরে ঝিরি-ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই বালাসীঘাট থেকে যাত্রা শুরু হলো নৌকাটির। এরপর নৌকা চলতে থাকলো ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর উড়িয়া, চর কাবিলপুর, ফজলুপুর ইউনিয়নের কয়েকটি ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি চরের পাশ দিয়ে। পৌনে দুই ঘণ্টা পরে নৌকা ভিড়লো দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটের ফুটানি বাজার এলাকায়।
পরে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে দুপুর আড়াইটার নৌকায় যাত্রী পর্যাপ্ত হওয়ায় পুরাতন ফুলছড়ি ঘাটের উদ্দেশ্যে ২ টার সময় নৌকা ছেড়ে পৌঁছে বিকেল সোয়া চারটায়। এখানে প্রত্যেকের ভাড়া নেয়া হয় ১২০ টাকা করে। এ নৌকাতেও ছিল না কোনো লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে নদী ছিল উত্তাল। ছিল ঢেউ, বড় বড় পাক ও স্রোত। যা বর্ষাকালে নদীপথে যাতায়াত করা বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েকদিন আগেও ঘটেছে দুর্ঘটনা। নৌকা দুটিতে যাতায়াতে লক্ষ্য করা গেছে যাত্রী ছিল পুরো নৌকাজুড়েই, কোথাও ছিল না একটুও ফাঁকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট বাহাদুরাবাদ থেকে বালাসীঘাট আসার পথে ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া এলাকায় নৌকা থেকে যমুনা নদীতে পড়ে গিয়ে রজ্জব আলী, গত বছরের ১৪ অক্টোবর মহড়া দেয়ার সময় সদর উপজেলার কামারজানী ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদে একটি নৌকাবাইচের নৌকা ডুবে এম এ লতিফ ও ফুলমিয়া, ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে যমুনা নদীতে নৌকাডুবে মোর্শেদা আকতার নামে পঞ্চম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট সদর উপজেলার কামারজানী ইউনিয়নের কড়াইবাড়ীর চর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকাডুবে তাসলিমা বেগম, আইতুল্যা ও সোহরাব মিয়া, ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সাঘাটা উপজেলার হাসিলকান্দি এলাকায় যমুনা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবে ইসমাইল হোসেন নামের এক ব্যক্তি ও ২০১২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফুলছড়ি উপজেলায় নৌকা থেকে যমুনা নদীতে পড়ে গিয়ে গাইবান্ধা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মতিউর রহমান লিটন মারা যান।
এতসব প্রাণহানির পরেও নৌপথে যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে নেয়া হয়নি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। নৌকাগুলোতে নেই মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনীয় উপকরণ। বর্ষাকালে নৌ-দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি।
নাম বলতে অনিচ্ছুক ঢাকাগামী এক যাত্রী (৩৫) বলেন, প্রতিটি লাইফ জ্যাকেটের সর্বনিম্ন দাম ৪০০ টাকা হলেও নৌকাগুলোতে নেই জীবন বাঁচানোর পর্যাপ্ত উপকরণ। তার বদলে নৌকায় আছে মাত্র দুইটি লাইফ বয়া। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এটা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাঘাটার মনোয়ার হোসেন নামের এক নৌযাত্রী বলেন, নৌকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে বেশি। প্রচণ্ড রোদে কষ্ট পেতে হয় আমাদের। এজন্য উঁচু করে যতোটা সম্ভব, নৌকার উপরে কিছু একটা দিয়ে নৌকায় ছায়া পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া চলাচল করছে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নৌকাচালক বলেন, রোদ থেকে রক্ষা পেতে নৌকাগুলোতে ছইয়ের (বাঁশ দিয়ে তৈরি) ব্যবস্থা করলে যাত্রীরা উপরে ওঠার জন্য মারামারি পর্যন্ত করে। এজন্য ছইগুলো খুলে রাখা হয়েছে।
বাহাদুরাবাদ ফুটানির বাজার ঘাটের ইজারাদার মো. তমছের আলী মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিটি নৌকায় দুটি করে লাইফ বয়া দিয়েছি। এ সংখ্যা আরও বাড়ানো যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তমছের আলী বলেন, আরও বাড়াতে হবে। এখন পারিবারিক কাজে ভীষণ ব্যস্ত আছি। দুই-তিন দিন পরে আরও সাত-আটটা লাইফ বয়া কিনে এনে নৌকাগুলোতে দেব।
নৌকাগুলোতে কেন জীবন বাঁচানোর উপকরণ রাখা হয় না এ প্রশ্নের জবাবে বালাসীঘাটের ইজারাদার শেখ সর্দার আসাদুজ্জামান হাসু মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, আছে, আমরা দিয়ে দিচ্ছি। লাইফ জ্যাকেট তো সবাইকে দেয়া সম্ভব না। লাইফ বয়া আছে, লাইফ জ্যাকেট আছে একটা-দুইটা দিয়ে দেই। তাৎক্ষণিকভাবে যাতে একটা লোককেও সেভ করতে পারি, এজন্য জরুরিভাবে সে ব্যবস্থাগুলো আমি নিচ্ছি। প্রতিটা নৌকায় আমি জীবন বাঁচানোর উপকরণ দিচ্ছি।
প্রতিটা নৌকাতেই পর্যাপ্ত পলিথিন দেয়া আছে। নৌকায় পর্যাপ্ত পলিথিন রাখতে সব নৌকাচালকদের বলা হয়েছে। ৩০ থেকে ৩৫ টন ওজন বহন করতে পারে নৌকাগুলো। যাতে বেশি যাত্রী নিয়ে নৌচালকরা যাতায়াত করতে না পারে সেদিকে নজর রয়েছে আমাদের।
ঈদের আগে হয়তো বেশি ভাড়া নেয়। ঈদের পরে হয়তো ১০০ টাকায় চলে। আমাদের নিয়ম আছে নৌকায় যদি ১০ জন যাত্রীও হয় তাহলেও নৌকা ছাড়ে। কিন্তু নৌকা চলাচল কখনও বন্ধ রাখা হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, বালাসীঘাট থেকে ফুটানির বাজারের নৌকার যাত্রী ৫ থেকে ১০ জনও হয়। তখন লোকসানে পড়তে হয়। ১০টা লোকও হয় তাহলেও আমার সিরিয়ালের নৌকা যাবে। কোনোদিন দেখা যায় যে, চারটা সিরিয়ালে একজন লোক হয়। তাহলেও আমরা সিরিয়ালের নৌকা পাঠিয়ে দেই। যাতে দুইপাড়ের যোগাযোগটা ঠিক থাকে। নৌপথের কোনো সমস্যা থাকলে ইজারাদারকে যে কেউ জানাবেন। ইজারাদার ব্যবস্থা নেবে।
এমএএস/এমএস