কক্সবাজারে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের দাবি
কক্সবাজারের আদালতে মামলার অস্বাভাবিক জট ক্রমে বাড়ছে। মামলার জটে বিচারক, বিচার প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের কাহিল অবস্থা পাড় করতে হচ্ছে। একজন বিচারক গড়ে দৈনিক ৪/৫টি করে মামলা নিষ্পত্তি করেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। মামলার অনুপাতিক হারে বিচারকের স্বল্পতায় মামলার নিষ্পত্তি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কেবল একটি আদালতেই ছয় শতাধিক হত্যা মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। তাই মামলার জট কমাতে কক্সবাজারে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে।
শনিবার কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ও পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনে মামলা জটের এ ভয়াল চিত্র তুলে ধরেন জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদার।
সভায় জানানো হয়, জেলার আদালতগুলোতে বিচারাধীন রয়েছে ৬৪ হাজার ৫১৪টি মামলা। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আওতায় ৯টি এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট আদালতে ১২টিসহ ২১টি আদালতে এত বিপুল সংখ্যক মামলা দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন রয়েছে। এসবের মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৪৪ হাজার ৭৫২টি এবং দেওয়ানি মামলা ১৯ হাজার ৭৬২টি।
সভায় জেলা জজ বলেন, কক্সবাজার হচ্ছে ‘বি’ শ্রেণির জেলা। দেশের পুরানো জেলাগুলোই কেবল ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। এসব ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত জেলাগুলোতে আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বেশি। তাই মামলার সংখ্যা যতই বেশি হোক না কেন পুরানো জেলাগুলোতে তেমন সমস্যা হয় না।
কিন্তু কক্সবাজার হচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলার চাইতে ভিন্ন ধরনের জেলা। এখানে অপরাধের মাত্রা এবং হার অত্যধিক বেশি। দেশের বি শ্রেণিভুক্ত অন্যান্য জেলাগুলোর চাইতে মামলার সংখ্যা কক্সবাজারে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু বি শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় এখানে সুযোগ সুবিধা কম। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন কক্সবাজারকে ‘বি’ থেকে ‘এ’ তে উন্নীত করা।
সভায় বিচার প্রার্থী সাধারণ লোকজনের ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে বক্তারা অবিলম্বে কক্সবাজারের আইন-আদালত অঙ্গণকে ‘বি’ থেকে ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত করে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের দবি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন এবং মানব পাচার আইন সংশোধন করার দাবিও জানানো হয়।
জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিজিবি কক্সবাজার সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল এমএম আনিসুর রহমান, পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ, সিভিল সার্জন ডা. কমর উদ্দিন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্র্যাইব্যুনালের বিচারক সুলতান মাহমুদ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. নুরুল ইসলাম, প্রধান জেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ তৌফিক আজিজ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট একে আহমদ হোছাইন, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক খান কায়সার, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ আহমদ, সরকারি কৌশুলি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, নারী ও শিশু আদালতের পিপি অ্যডভোকেট নুরুল ইসলাম, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও অ্যাডভোকেট নুরুল মোস্তফা মানিক, অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আলম, অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম, অ্যাডভোকেট সুলতানুল আলম, কক্সবাজার সদর থানার ওসি কাজী মতিউল ইসলাম ও মহেশখালী থানার ওসি (তদন্ত) দিদারুল ফেরদৌস প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
সভায় বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এমএম আনিসুর রহমান কক্সবাজারে এত বিপুল সংখ্যক মামলার জট লেগে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিলম্বিত বিচারের প্রতি মানুষের অনীহার জন্ম দেয়। সমাজে হতাশা নেমে আসে। একটি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় বের করার উপর গুরুত্বরোপ করেন।
সভায় জেলা সিভিল সার্জন ডা. কমর উদ্দিন বলেন, মেডিকেল সনদ প্রদানে আগের দিন বদলে ফেলা হয়েছে। এখন তিন জন ডাক্তার মিলে মেডিকেল সনদ প্রদান করে থাকেন। তিনি দুঃখের সাথে বলেন, পুরো এক বছর পর আমার কাছে একটি হত্যা মামলার ময়না তদন্তের রিপোর্ট স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হয়। পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মামলায় সাক্ষীদের হাজির করানোর জন্য পুলিশ এখন থেকে সিরিয়াস হয়ে কাজ করছে।
সভায় কয়েকজন বক্তা জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পচিালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে জেলা ও দায়রা জজ বলেন, মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ সালের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেই অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ অপরাধীকে ধরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নিয়ে গিয়ে শাস্তির ঘোষণা দিচ্ছে- যা বিধি সন্মত নয়।
এ প্রসঙ্গে জেলা ও দায়রা জজ বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, ঘুম থেকে তুলেও মোবাইল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তদুপরি ১৪৪ ধারার মামলার নির্ধারিত সময় হচ্ছে দুই মাস। কিন্তু এক্ষেত্রে তিন-চার মাসের পরও এসব মামলায় ম্যজিস্ট্রেটের অর্ডার প্রদানের ঘটনাও ঘটছে- যা আইন সঙ্গত নয় বলেও বলা হয়।
বক্তারা মানবপাচার ও ইয়াবা পাচার প্রতিরোধের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এসব মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সমস্ত লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সেই সঙ্গে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য ও আলামত সংরক্ষণের উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগ রয়েছে বলে তিনি জানান। ডা. সাইফুল ইসলাম নামের একজন সরকারি চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে বহু সংখ্যক হত্যা মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া প্রসঙ্গেও আলোচনা করা হয় সভায়।
সায়ীদ আলমগীর/বিএ