মুন্না ও তার ‘ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শারীরিক প্রতিবন্ধী হেদায়তুল আজিজ মুন্না এখন অনেক প্রতিবন্ধীর অনুপ্রেরণা। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, সে লড়াইয়ে একে একে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। লড়াইয়ে অনেকখানি সফলতাও পেয়েছেন তিনি।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত ‘ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন’ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছে। এ সংগঠনের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হুইল চেয়ার ক্রিকেট সিরিজে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।
মুন্না ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার আইনজীবী আজিজুর রহমানের ছেলে। তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে ২০০৩ সালে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানে চাকরির পাশাপাশি নিজের ব্যবসাও ছিল তার। এভাবে ভালোই কেটে যাচ্ছিল জীবন। তবে একটি সড়ক দুর্ঘটনা সবকিছু বদলে দেয় মুন্নার।
২০০৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে ফুটপাতে উঠিয়ে দেন গাড়ি। এতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় গাড়িটি। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মুন্নাকে সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ঘটনায় প্রাণে রক্ষা পেলেও স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির করণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন মুন্না। ২২ দিন কোমায় থাকার পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে মুন্নাকে দেশে এনে ঢাকার রেনেসা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকার সাভারের সিআরপিতে কয়েক মাস থাকার পর বাড়ি নিয়ে আসা হয়।
এরপর নিজের প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পাশাপাশি সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নামেন তিনি।
ফেসবুকে পরিচয় হওয়া টাঙ্গাইলের আরেক শারীরিক প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন। এ সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ শুরু করেন তারা। শুরু থেকেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুন্না। এখন একটি একীভুত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন। প্রশিক্ষণের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশে চাকরিও পেয়েছেন দুইজন প্রতিবন্ধী।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও রয়েছে এ সংগঠনের সদস্যদের। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ ও ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ভারত ও বাংলাদেশের ৬৪ জেলা থেকে আসা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে উদযাপন করা হয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
দেশের অন্যান্য জেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের যুক্ত করে ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট দল ও হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করা হয়েছে। দীর্ঘ চেষ্টার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ক্রিকেট দল গঠন করেছে। এবার মুন্নাদের লক্ষ্য জাতীয়ভাবে হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানের সহযোগিতায় গেল এপ্রিল মাসে ভারতের দিল্লিতে গিয়ে হুইল চেয়ার ক্রিকেট সিরিজে ভারত দলকে হারিয়েছে ড্রিম ফর ডিস্অ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের দল।
আগামী নভেম্বর মাসে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া কাপ ক্রিকেটেও অংশ নেবে এ সংগঠনের সদস্যরা।
মুন্না জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। অন্যদের মতো আমরাও সমানভাবে সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে চাই। এখন প্রতিবন্ধীরাও নিজেদের মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য খেলাধুলাকেই আমি বেছে নিয়েছি। কারণ কোনো মানুষ যখন দেখবে প্রতিবন্ধীরা হুইল চেয়ারে বসে খেলছে সেটা মানুষকে নাড়া দেব। এর মাধ্যমে দ্রুত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যেভাবে কাজ করছেন তাতে করে একদিন সারা বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের দিকে আর কেউ বাঁকা চোখে তাকাবে না।
আজিজুল সঞ্চয়/এফএ/আরআইপি