খাগড়াছড়িতে আধিপত্য বিস্তারে সাত মাসে ১০ খুন
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি। অনিবন্ধিত এসব সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যা। দু’পক্ষের মুখোমুখি বন্দুকযুদ্ধ ছাড়াও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়ে উঠেছে সবুজ পাহাড়ে। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে গত সাত মাসে এখানে ১০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
আর এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস, এমএন-লারমা) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) একে অপরকে দায়ী করছে। তবে এসব খুনের ঘটনায় প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ আর গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে বিবদমান সংগঠনগুলো।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে জুলাই অবধি পাহাড়ের বিবাদমান আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের ছয় কর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন-লারমা) চার কর্মী খুন হয়েছেন।
চলতি বছরে পাহাড়ে বিবদমান সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের প্রথম বলি ইউপিডিএফের সংগঠক মিঠুন চাকমা প্রকাশ জুম্মা। ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার স্লুইচ গেট এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন তিনি। মিঠুন চাকমা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই পাহাড়ে শুরু হয় লাশের মিছিল। যা এখনো অব্যাহত আছে।
খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা হত্যাকাণ্ডের এক মাস পার হতেই দীলিপ কুমার চাকমা নামে এক ইউপিডিএফ কর্মী খুন হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার রাঙাপানি ছড়া এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।
ইউপিডিএফ কর্মী দীলিপ কুমার চাকমা হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় ২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় দু’পক্ষের গোলাগুলির ঘটনায় ইউপিডিএফ সদস্য সাইন চাকমা ওরফে সুপার (২৩) নিহত হন। এ ঘটনায় আরও তিন ইউপিডিএফ কর্মী আহত হন।
পরে ২২ এপ্রিল পানছড়ির উল্টাছড়ি ইউনিয়নের মরাটিলা এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ নেতা সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা কাতাং (৩৮) নিহত হন। এ সময় অনন্ত ত্রিপুরা (২৫) নামে ইসকন মন্দিরের এক সাধক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
ইউপিডিএফ নেতা সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা কাতাং খুনের এক মাসের মাথায় ২২ মে দীঘিনালার গুলছড়ি রাখাল মহাজনপাড়ার তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ওরফে মার্শাল (৫০) নামে ইউপিডিএফের (প্রসীত বিকাশ খীসা) এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।
ইউপিডিএফ কর্মী খুনের দুই মাসের মাথায় ১৬ জুন পানছড়িতে বিজয় কুমার ত্রিপুরা নামে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমা) এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত বিজয় কুমার ত্রিপুরা পানছড়ির পাইয়ংপাড়ার বাসিন্দা। অভিযোগ রয়েছে নিজের টিলা ভূমিতে কাজ করার সময় স্বশস্ত্র ইউপিডিএফ সমর্থকরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে পালিয়ে যায়।
কদিন বিরতির পর ১২ জুলাই খাগড়াছড়িতে জ্ঞানেন্দু চাকমা (৪০) নামে প্রসীত বিকাশ খীসা সমর্থিত ইউপিডিএফের এক কর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। খাগড়াছড়ি-ঢাকা আঞ্চলিক সড়কের আলুটিলা পর্যটন এলাকায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত জ্ঞানেন্দু চাকমা জেলার মহালছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইউপিডিএফের কালেক্টর হিসেবে কাজ করতো বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার মাত্র তিন দিনের মাথায় ১৫ জুলাই প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) সমর্থিত মাটিরাঙ্গা উপজেলা যুব সমিতির সভাপতি শান্তি জীবন চাকমা (৪০)। গুলি করে হত্যার পর গলাকেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রতিপক্ষ। নিহত শান্তি জীবন চাকমা সর্বস্বের পাড়ার রাঙ্গাচোখা চাকমার ছেলে।
এছাড়াও ৪ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে অ্যাড. শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে রাঙামাটির নানিয়ারচরের বেতছড়ি এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সমর্থিত মহালছড়ি উপজেলা যুব সমিতিরি সভাপতি সুজন চাকমা ও কেন্দ্রীয় নেতা সেতু লাল চাকমা।
পাহাড়ের এসব অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যকার লাগাতার খুনোখুনির ঘটনায় চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কে ভুগছেন পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ইউপিডিএফ-জেএসএস’র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই হিসেবেই দেখছে পাহাড়ের মানুষ।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এফএ/জেআইএম