ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ঠাঁই পেলেন সেই মা, শোনালেন জীবনের গল্প

জেলা প্রতিনিধি | কুড়িগ্রাম | প্রকাশিত: ০৩:১২ পিএম, ১৩ জুলাই ২০১৮

ঢাকায় ওভারব্রিজের নিচে আশ্রয় নেয়া অসুস্থ মা, তার স্বামী ও সন্তানদের অবশেষে ঠাঁই হলো কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নে।

জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় পরিবারটিকে সদর ইউএনও আমিন আল পারভেজ, এনডিসি সুদীপ্ত কুমার সিংহ এবং কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাড. আহসান হাবীব নীলু পাঁচগাছিতে নিয়ে যান।

এরআগে রাতের কোচে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাদুল আবেদীন ডলার। সকাল ৭টায় পরিবারের সদস্যরা কুড়িগ্রাম শহরে পৌঁছালে তাদেরকে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নিয়ে আসা হয়। সেখানে নিজের জীবনের কথা শোনান ফরিদা বেগম (৪০) ও তার স্বামী আনছার আলী (৬০)।

জেলার উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর মৌজার মরাকাটি গ্রামে বাড়ি ছিল ফরিদার স্বামী আনছার আলীর। ছিল ২ একরের বেশি ধানী জমি। দুধের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল পরিবারটি। প্রতিদিন ২ মণ করে দুধ সংগ্রহ করে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল মাড়িয়ে কুড়িগ্রাম শহরের হোটেলগুলোতে বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু ব্রহ্মপূত্র নদের করাল গ্রাসে ২০১৬ সালে এক মাসের মধ্যে বাড়িঘর, আবাদি জমি সব বিলীন হয়ে যায়। গৃহহীন হয়ে পড়ে গৃহস্ত পরিবারটি। তাদের সঙ্গে আরও দেড়শ পরিবার ভিটেমাটি হারান। শেষে আশ্রয় মেলে ইসলামপুরে জ্যাঠাত ভাইয়ের গোয়াল ঘরে। সেখানে একমাস থাকার পর ঢাকায় চলে যায় পরিবারটি।

kurigram-2

ফরিদা বেগম বলেন, ‘বাপুরে অনেক কষ্টের জীবন মোর। মুই (আমি) জন্মানো সাত দিনের মাথায় মোর মা মরি যায়। এরপর বাপ কটে (কোথায়) চলি গেছে কাইও (কেউ) কবার পায় না। এতিম ছওয়ার কাইও দায়ভার নেয় নাই। ৫ বছর বয়সোত অভাবোত পড়ি মোর নানী কুলসুম আর খালা তারামনি মোক সিতাইঝাড়োত ছিন্নমুকুল এনজিওত থুইয়া আইসে। সেটে (সেখানে) ৭ বছর থাকপের পর ক্লাস সিক্সত পড়বের সময় ছিন্নমুকুল উঠিয়া যায়। মুই নানীর বাড়িত ফিরি আইসং। সেটে মোর বিয়ে দেয়া হয়। সেই বিয়া ৩ মাসের মাথায় ভাঙি যায়। ইয়ার দুই বছর পর বর্তমান স্বামী আনছার আলীর সাথে মোর বিয়ে হয়। ওমারও (তারও) এটা দ্বিতীয় বিয়ে। ওমার প্রথম বউ আমেনা ডায়রিয়া হয়া মরি যায়।’

এই হলো ভাঙন কবলিত আনছার আলী আর ফরিদা বেগমের জীবন কাহিনী। অভাব-অনটন আর মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে তারা নভেম্বর মাসে ঢাকায় পাড়ি দেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষে আশ্রয় নেন কলাবাগান ওভার ব্রিজের নিচে। পলিথিনের তাবু টানিয়ে বসবাস করতেন তারা।

সেখানে ধানমন্ডী ক্রীড়া চক্রক্লাবের দাঁরোয়ান জামালের সহযোগিতায় মাঠের পাতা কুড়ানোর কাজ করে দিনে আয় হতো দু’শ থেকে আড়াইশ টাকা। সেই অর্থেই চলছিল মানবেতর জীবন। মাঝখানে কাজটাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল পরিবারটিকে।

সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে বেরিয়ে পড়েন ফরিদা বেগম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে আকলিমা (১১) প্রতিবন্ধী এবং সাড়ে তিন বছরের ছোট ছেলে ফরিদুল ইসলামকে নিয়ে তারা থাকতেন। দ্বিতীয় কন্যা আখিতারা (৭) থাকত গ্রামের বাড়িতে চাচির কাছে।

ফরিদা বেগম জানান, ঘটনার দিন দু’সন্তানকে নিয়ে কলাবাগান থেকে ল্যাব এইডের দিকে ভিক্ষা করতে বের হন। অসুস্থ শরীর নিয়ে বের হওয়ার ফলে ল্যাব এইডের কাছে ফুটপাতেই পড়ে যান তিনি।

kurigram-3

সেই স্মৃতি মনে করে ফরিদা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছওয়া (বাচ্চা) দুইটা না খায়া আছে। মা হয়া কেমন করি বসি থাকং (থাকি)। অসুস্থ শরীর নিয়া তাই ভিক্ষা করার জন্যে বের হয়া পড়ং। ঘোরের মইধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চোখ মুখ আন্ধার দেখি সেটেই উল্টি পড়ং। মনে হবার নাগছিল আজক্যা মনে হয় মোর শ্যাষ দিন। বড় বেটি মোক ধরি থাকে। আর ছোট বেটা সোবহানবাগ মসজিদ থেকে বোতলত করি পানি নিয়া আসি মোর মাথাত ঢালে। তারপর কী হইল কাঁই (কে) জানে। মোক পরদিনোত লোকজন হাসপাতালোত নিয়ে যায়।’

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া কুড়িগ্রামের এই পরিবারটির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন। সন্তানসহ পুরো পরিবারটি কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে এলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেন সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম।

এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারটির খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবণসহ সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেন কুড়িগ্রাম রেল-পরিবেশ যোগাযোগ উন্নয়ন গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম।

কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। আমাদের ১২টি দাবির সঙ্গে ‘কুড়িগ্রামের সকল ভূমিহীনদের পুনর্বাসন চাই’ দাবিটি সংযুক্ত করছি।

kurigram-4

কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাড. আহসান হাবীব নীলু জানান, জেলায় বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রতি বছর শত শত পরিবার বাড়ি ভিটা হারাচ্ছে। নদী তীরবর্তী উন্মুক্ত এলাকায় নদী শাসনের ব্যবস্থা না করায় বানভাসী ও গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফরিদার মতো হাজারও মানুষ এখন বড়বড় শহরের পথে ঘাটে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব মানুষদের পুনর্বাসন করা জরুরি।

সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, নিয়মিত খাদ্য আর পুষ্টির অভাবে পুরো পরিবারটি স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে। খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পেলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন এ পরিবারটিকে অস্থায়ীভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের নির্দেশে তাদের তিন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানান, সরকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকলের উচিৎ সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।

নাজমুল হাসান/এফএ/পিআর

আরও পড়ুন