জীবন বাঁচানো বন্ধুকে ৫ টুকরা করল বন্ধু
বন্ধু কঠিন রোগে আক্রান্ত। অসুস্থ বন্ধুকে নিজের টাকা দিয়ে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন বন্ধু। অথচ সেই বন্ধুই কাল হয়ে দাঁড়াল। কে জানত জীবন বাঁচানো বন্ধুর ঋণের প্রতিদান এভাবেই পাবে বন্ধু।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন ঘাতক হয় তখন বন্ধুত্বের সম্মান থাকে না। যে বন্ধু নিজের সব কিছু উজাড় করে একদিন বন্ধুকে বাঁচিয়েছেন সেই বন্ধুই কিছুদিন পর বন্ধুকে মেরে ফেললেন। বন্ধু প্রবীর ঘোষকে পরিককল্পিতভাবে হত্যা করে লাশটি টুকরা টুকরা করে নিজের বাড়ির সেপটিক ট্যাংক ফেলে দেন বন্ধু পিন্টু দেবনাথ।
সোমবার রাত ১১টায় পিন্টু জুয়েলার্সের মালিক পিন্টু দেবনাথের বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে ভোলানাথ জুয়েলার্সের মালিক প্রবীর ঘোষের ৫ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা জানান পুলিশ সুপার মঈনুল হক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরফুদ্দিন প্রমুখ।
পুলিশ জানায়, প্রবীর ঘোষের এক ভাই ইতালি প্রবাসী। তার পাঠানো টাকা দিয়ে পিন্টু ও প্রবীর সুদের ব্যবসা করত। কিছু টাকা ছিল পিন্টুর কাছে। এসব নিয়ে পিন্টুর সঙ্গে প্রবীরের বিরোধ ছিল। প্রবীর ঘোষের সন্ধানকালে তার ব্যবহৃত মোবাইলটি কুমিল্লার সীমান্ত এলাকায় ব্যবহার হওয়ার সন্ধান পায় পুলিশ। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় পিন্টুর দোকানের কর্মচারী বাপন ভৌমিক বাবুকে। তার দেয়া তথ্যমতে গ্রেফতার করা হয় পিন্টুকে।
জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম জানান, তারা দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গত ১৮ জুন প্রবীর চন্দ্র ঘোষ নিখোঁজ হলে পরিবারের জিডির ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ায় গত ৫ জুলাই তদন্তের ভার দেয়া হয় জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে সোমবার সকালে পিন্টু ও বাপেন ভৌমিককে বাবুকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রবীর চন্দ্র ঘোষকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে বলে স্বীকার করে তারা। তাদের দেয়া তথ্যমতে, পিন্টুর ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রবীরের লাশ উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম বলেন, স্বীকারোক্তিতে তারা জানায় নিখোঁজ হওয়ার দিন প্রবীরকে পিন্টুর ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে তারা। ওই ফ্ল্যাটেই হত্যাকাণ্ডের পর প্রবীরের লাশ টুকরা করে বস্তায় ভরে সেপটিক ট্যাংকে গুম করা হয়।
পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেন, প্রবীর ঘোষের ভাই সৌমিক ঘোষ ইতালি প্রবাসী। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হয় প্রবীর ঘোষের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই টাকা লেনদেন হতো প্রবীর ও পিন্টুর মধ্যে।
সম্প্রতি সৌমিক ঘোষ যখন দেশে আসে তখন থেকেই নিখোঁজ ছিল প্রবীর। সৌমিক দেশে আসার আগেই টাকার জন্য পিন্টুকে চাপ দিতে থাকে প্রবীর। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। পরে পরিকল্পনা করেই প্রবীরকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে পিন্টু ও তার দোকানের কর্মচারী বাপেন ভৌমিক। পিন্টুর ফ্ল্যাটে প্রবীরকে হত্যার পর সেপটিক ট্যাংকে লাশ ব্যাগে করে ফেলে দেয়া হয়।
প্রবীর ঘোষের পরিবার জানায়, প্রবীর ঘোষের মালিকানাধীন ভোলানাথ জুয়েলার্সের পাশেই পিন্টু জুয়েলার্স। পিন্টু জুয়েলার্সের মালিক পিন্টু দেবনাথের সঙ্গে প্রবীর ঘোষের বন্ধুত্ব অনেক পুরনো। তারা একে-অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুই বছর আগে পিন্টু দেবনাথ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। একবার হয় স্ট্রোক। এর কিছুদিন পর হার্ট অ্যাটাক করে পিন্টু। দুবারই পিন্টু দেবনাথের অবস্থা হয় সংকটাপন্ন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন পিন্টু ঠিক তখনই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বন্ধু প্রবীর ঘোষ। উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান ভারতের মাদ্রাজে। সেখানে পিন্টুর ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। বন্ধুর পরিচর্যার দায়িত্ব নেন নিজের কাঁধে। এর জন্য যত টাকা ব্যয় হয়েছে সব বহন করেন বন্ধু প্রবীর ঘোষ। সংসার চালানোসহ যত খরচ সব কিছু দেন প্রবীর ঘোষ। কখনও বন্ধুকে কষ্ট অনুভব করতে দেননি। পিন্টু দেবনাথকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য অর্থনৈতিক কোনো কষ্টই বুঝতে দেননি প্রবীর। অথচ সেই বন্ধুই কাল হয়ে দাঁড়াল। বন্ধুকে হত্যার পর টুকরা টুকরা করে লাশ ফেলে দেয় সেপটিক ট্যাংকে।
নিখোঁজের ২১ দিন পর সোমবার (৯ জুলাই) রাত ১১টায় শহরের আমলপাড়া এলাকার ঠান্ডু মিয়ার চারতলা ভবনের নিচে সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রবীরের টুকরা টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়।
এর আগে তার সন্ধান দাবিতে ২১ দিন ধরে বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ী, নিহতের স্বজন, বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবারের লোকজন মানববন্ধন ও সমাবেশ করে আসছিল। এর মধ্যে নিহতের পরিবার প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেয়।
শাহাদাত হোসেন/এএম/পিআর