দোয়ারীতে স্বাবলম্বী পদ্মা তীরের ৩শ পরিবার
বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ফরিদপুরের চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় ধুম পড়েছে দোয়ারী কেনা-বেচায়। ব্যস্ত সময় পার করছে দোয়ারী তৈরির কারিগররা। পদ্মা নদী পারের দুস্থ পরিবারগুলোর দোয়ারী তৈরি ও বিক্রি করাই প্রধান পেশা। বর্ষাকালে এই কাজের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। বর্তমানে দোয়ারীই দুই উপজেলার প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এই দোয়ারী যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
জানা যায়, চরভদ্রাসন উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়নে দোয়ারী পট্টি নামে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি গ্রাম। উপজেলার চরঅযোধ্যা বাঞ্চারাম বিশ্বাসের ডাঙ্গী, ঢালার পাড়, চরহরিরামপুর ইউনিয়নের আরজখার ডাঙ্গী, ইন্তাজ মোল্যার ডাঙ্গী, আমিন খার ডাঙ্গী, চরসালেপুর গ্রাম ও সদর ইউনিয়নের করিম মৃধার ডাঙ্গী, টিলারচর, জাকেরের সুরাসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার দোয়ারী তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এ ছাড়া সদরপুর উপজেলার ঢেউখালি, দুয়াইর, চরবলাশিয়া, পেঁয়াজখালি, আকোটেরচর, শয়তানখালী, রামসুন্দরের ডাঙ্গি, চরনাসিরপুর, চরমানাইর গ্রামের শতাধিক পরিবার দোয়ারী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সদরপুর উপজেলার ঢেউখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বেপারী বলেন, এখন উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রামে দোয়ারী তৈরির কাজে ব্যস্ত কারিগররা। বর্ষা মৌসুমের তিন মাস তারা ব্যস্ত থাকে এ পেশায়। বছরের অন্য সময়ে দোয়ারীর চাহিদা কম থাকে। তবে চাহিদা যেমনই থাকুক না কেন? এই দোয়ারী তৈরি করে তারা স্বাবলম্বী।
পদ্মা পারের চরহাজীগঞ্জ হাটে সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মা পারের উন্মুক্ত বালুচরে দোয়ারীর হাট বসেছে। ছোট ও বড় দোয়ারীস্তুপগুলো শতক হারে বিক্রি হচ্ছে। ছোট্ট আকারের ১০০ দোয়ারী সাড়ে ৫ হাজার টাকা এবং বড় আকারের ১০০ দোয়ারী সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ব্যবসায়ীরা হাটে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা দোয়ারী কিনে ঘাটে থাকা ট্রলারে কেউ ভ্যান বোঝাই করে পদ্মা নদীর বিভিন্ন ঘাটে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে দোয়ারী ঢাকা জেলার নারিশা, মাওয়া, কার্তিকপুর, বাহ্রা ঘাট, রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া, গোয়ালন্দ ও সিরাজগঞ্জ জেলাসহ নদী বেষ্টিত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নেয়া হচ্ছে।
হাটে দোয়ারী বিক্রি করতে আসা আসলাম জানান, উপজেলা পদ্মা পারের বেশিরভাগ দুস্থরা বর্ষা মৌসুমে ঘরে বসে বাঁশ ও বেত দিয়ে দোয়ারী তৈরি করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে পদ্মায় জোয়ার এলে এ শিল্পের কদর বাড়ে। এ সময় দেশের নদ-নদী, খাল- বিলে জোয়ারের পানিতে ছেয়ে গেলে জলমহলের স্রোতের ধরন বুঝে দোয়ারী পাতা হয়। তিনি জানান, মৎস্যজীবীরা প্রতিদিন সকাল বিকাল দু’বেলা দোয়ারীতে আটকে পড়া মাছগুলো বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাই বর্ষা মৌসুমে দোয়ারীর চাহিদা বেশি থাকে।
দোয়ারী পট্টি গ্রামের রহিম শেখ জানান, বড় একটি বাঁশ কিনে অন্তত ৪টি দোয়ারী তৈরি করা যায়। প্রতিটি দোয়ারী ২০০ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। একটি বাঁশ কিনতে হয় ২০০-৩০০ টাকায়।
সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার উপজেলার চরহাজীগঞ্জ বাজারে বসে দোয়ারী বিক্রির হাট। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তৈরিকৃত দোয়ারী নিয়ে হাটে আসেন বিক্রেতারা। আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে এসে দোয়ারী কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান।
ঢাকা থেকে আসা দোয়ারী ব্যবসায়ী জামাল মোল্যা বলেন, অত্র অঞ্চলের দোয়ারীগুলো মজবুত ও টেকসই বিধায় এ অঞ্চলের দোয়ারীর চাহিদা বেশি। এ উপজেলা থেকে দোয়ারী কেনার পর পদ্মা নদী দিয়ে ট্রলারযোগে সিরাজগঞ্জ জেলায় নিয়ে সেখানে বিক্রি করি। এসব দোয়ারী দিয়ে মৌসুমের তিন মাস প্রচুর পরিমাণে চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ ধরা হয়।
চরভদ্রাসন উপজেলা চেয়ারম্যান এ জি এম বাদল আমিন বলেন,বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই দোয়ারীর বেশ চাহিদা থাকে। উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক পরিবার দোয়ারী শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা পেলে এ শিল্পের আরও ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
আরএ/জেআইএম