অশ্রুসিক্ত চোখে শেষ প্রার্থনা তাদের
ভারত যেতে নাম লেখাইছি। যেকোনো সময় বাংলাদেশ ছাড়া লাগবে। নিজ দেশ ভারতে যাবো। এখানে অনেক ভাই-বেড়াদার থাকবে। আমরা চলে যাবো। পাড়া প্রতিবেশিরা থেকে যাবে। শত বছরের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও নিজ মাতৃভূমির টানই বড় কথা। এ জন্য পূঁজা- অর্চনার আয়োজন করা হয়েছে।
রোরবার থেকে শুরু করে আগামী বৃহস্পতিবার ৫ দিনব্যাপি এ অনুষ্ঠান চলবে। কথাগুলো মন খারাপ করে বলছিলেন কৃষ্ণকান্ত বর্মণ।
কুড়িগ্রামের সাবেক ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার দেবিরপাঠ গ্রামের বাসিন্দা। তার বাড়ির উঠোনে পূঁজো চলছে। মনসা পূঁজা। আয়োজন করা হয়েছে বেশ বড়-সড় করেই। উপস্থিত রয়েছে শতাধিক ভক্তকূল। তবে আরও অনেকে ভিড় হবে বলে জানান আয়োজকরা। তা দেখাও গেল কিছুক্ষণের মধ্যে ভরে গেল সামিয়ানার নিচটা। তিন শতাধিকেরও বেশি লোকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
দেবীরপাঠ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০ জন মানুষ ভারত যেতে মত দিয়েছেন। পূঁজা- অর্চনার মধ্য দিয়ে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভারতে যাবার। গ্রামের লিটন চন্দ্র বর্মণ, অনুকুল, মনমোহন, ধীরেন্দ্রনাথ বলেন, এতদিন আমরা ভারতের ভূ-খণ্ডে ছিলাম। চতুর দিকে বাংলাদেশ থাকায় কোথাও ভালোভাবে যেতে পারিনাই। এমনকি নিজ দেশ ভারতেও না। কিন্তু এবার নিজ দেশে পরিবার নিয়ে যেতে পারার আনন্দটাই খুশির জোয়ার এনে দিয়েছে তাদের মাঝে।
নিজেদের যাত্রায় মঙ্গল এবং বাংলাদেশে রেখে যাওয়া পাড়া-প্রতিবেশিদের মঙ্গলের জন্য যাবার আগে ছিটমহল স্বাধীনের একদিন পর পূঁজা-অর্চনার আয়োজন করে হয়। পূঁজা শেষে কীর্তন চলবে। রাত ভর চলে কীর্তন। চলবে ৫ দিনব্যাপি। উৎসব চলছে অশ্রুসিক্তে ভারী হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে এখানকার আনন্দঘন পরিবেশ। হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদাভেদ ছিলনা। পাড়া প্রতিবেশিদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদ্য বাংলাদেশি ভূ-খণ্ডে যুক্ত হওয়া দাসিয়ারছড়ায় চলছে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রিত আনন্দ-উৎসব মুখর পরিবেশ আবার কোথাও বা ভীত কর থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, আমরা ভারত যাবার জন্যে নিবন্ধন করায় আমাদের বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি-ধামকি আসছে। রাত ভারি হলেই ভয় বেড়ে যায় অজানা এক আতঙ্কে।
নিজেদের চাওয়ার কিছু নাই। সরকার যেভাবে নিয়ে যাবে তারা তাতেই খুশি। শান্তিতেই যেতে চায় তারা। যেতে চায় নিরাপত্তার সাথে দ্রুত। জমির বিষয়ে দু’রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের তেমন কিছু স্পষ্ট বলা হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়রা দাবি তুলেছেন যদি সরকার এখানকার জমিরগুলোর দাম নির্ধারণ করে দিত তবে সুবিধা হত।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, দাসিয়ারছড়াসহ সদ্য বাংলাদেশে ভূ-খণ্ডে যুক্ত হওয়া ভারতীয় ভূ-খণ্ডগুলোয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালোই রয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড থেকে কেউ বাংলাদেশে আসার জন্য মতামত ব্যক্ত করেনি অপর দিকে বাংলাদেশের ভূ- খণ্ডে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল থেকে ভারত যেতে ৭৭৯ জন মানুষ নিবন্ধন করেছেন। এদের মধ্যে ১৬৪ জন বাদে বাকিরা সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। জেলার ১২টি ছিটমহলে এক হাজার ৮৭৩ পরিবারে লোক সংখ্যা ৮ হাজার ১৩২ জন। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সাড়ে ৫ শতাধিক। দেড় শতাধিকেরও বেশি মানুষ ভারত যেতে নিবন্ধন করেছেন।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক খাঁন মো. নুরুল আমিন জানান, যারা ভারতে যেতে অভিমত দিয়েছেন আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কুড়িগ্রামের সাহেবগঞ্জসহ ৪টি পয়েন্ট দিয়ে ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে তাদের পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের অনুমতি স্বাপেক্ষে জমি কেনাবেচা করা যাবে। নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, দাসিয়ারছড়ায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা পুলিশি টহল চলছে। আর শুধু হিন্দু পরিবার নয় দাসিয়ারছড়াসহ কুড়িগ্রামের ১২টি ছিটমহলে নিরাপত্তা জোড়দার করা হয়েছে।
এমএএস/আরআইপি