‘সুপার ফাইভ’ কমিটি করে সরকারি পুকুর ভরাট
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন একটি পুকুর বালু ফেলে ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে গত এক মাস ধরে আশুগঞ্জ সাইলো সংলগ্ন পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে।
ভরাটের জন্য ‘সুপার ফাইভ’ নামে একটি কমিটিও করেছে প্রভাবশালী চক্রটি। যার আহ্বায়ক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ূব খান। তার নেতৃত্বেই চলছে ভরাট কর্মযজ্ঞ। তবে ওই পুকুরে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে তারা ভরাটের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে আপত্তি জানালেও রহস্যজনক কারণে বন্ধ হচ্ছে না ভরাট কার্যক্রম।
সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আশুগঞ্জ সাইলো ও চরচারতলা উত্তরপাড়া কবরস্থান সংলগ্ন পুকুরটিতে মোটা পাইপ দিয়ে বালু ফেলা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীর তীরে থাকা বালুর নৌকা থেকে দুটি পাইপে করে বালু এনে ফেলা হচ্ছে পুকুরে। অনেকটা শিফটিং ডিউটির মতো ভরাট কার্যক্রম তদারকি করছেন ‘সুপার ফাইভ’ কমিটির সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি চরচারতলা উত্তরপাড়া কবরস্থান কমিটি তাদের নিজস্ব ডোবা ভরাটের অনুমতি চেয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। এ প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোসাম্মৎ শাহিনা আক্তার তার অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে চরচারতলা মৌজার ১৭৫১ দাগের ভূমির ষোলাআনা মালিকানা নিরূপণ করে একটি প্রতিবেদন দেন। যাতে দেখা যায়, পুকুরটিতে ১৫ শতক জায়গার মালিক সরকারের পক্ষে খাদ্য মন্ত্রণালয়, ৩৬ শতক জায়গার মালিক বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন, উত্তরপাড়া কবরস্থান কমিটি ১০ শতক এবং চরচারতলা ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা ৩০ শতক জায়গার মালিক।
এর আগে কবরস্থানের উন্নয়ন, মরদেহ দাফন ও নামাজে জানাজার স্থান সংকুলানের সমস্যা নিরসনে ৪ মে এক সভায় কবরস্থান কমিটি পুকুরটিতে থাকা তাদের অংশ ভরাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবেদন করে প্রশাসনের কাছে। এরপরই স্থানীয় প্রশাসন সেটির মালিকানার অংশ চিহ্নিত করে সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। তবে সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে ১০ শতকের বদলে পুরো পুকুরই ভরাট করে ফেলা হচ্ছে।
মে মাসের শুরুতে পুকুর ভরাটের কাজ শুরু হলে মো. লাল মিয়া সরকার নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার করা আবেদনের প্রেক্ষিতে পুকুর ভরাট বন্ধ করে দেন জেলা প্রশাসক। এর মধ্যে খাদ্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে অবৈধভাবে তাদের জায়গা ভরাট করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করে। কিন্তু এর সপ্তাহ খানেক পর আবারও ভরাট কাজ শুরু হয়।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পুকুর ও কবরস্থানের পশ্চিমাংশে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের জন্য আইসিটি টার্মিনাল নির্মিত হবে। এটিকে লক্ষ্য করেই কবরস্থান উন্নয়নের নামে পুকুর ভরাট করে সেখানে মার্কেট করার পরিকল্পনা করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এজন্য তারা ২১ জনের একটি কমিটিও করে। এ কমিটির মধ্য থেকে পাঁচজনকে দিয়ে আরেকটি ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি করা হয়েছে। মূলত এ ‘সুপার ফাইভ’ কমিটির লোকজনই ভরাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জালাল নামে কমিটির এক সদস্য।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ুব খান ছাড়া ‘সুপার ফাইভ’ কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, স্থানীয় শফিক ব্রাদার্সের শফিকুর রহমান, টুক্কু মিয়া, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও মহিউদ্দিন মোল্লা।
তবে জালালের দাবি, পুকুরের মধ্যে ১০৭ শতক জায়গার মালিক তারা। সবার সিদ্ধান্তে কবরস্থানের উন্নয়নের জন্য নিজস্ব জায়গাই ভরাট করা হচ্ছে। এটি সওয়াবের কাজ। সাংবাদিকদেরও এ সওয়াবের কাজে সহযোগিতা করে ভরাট নিয়ে ‘উল্টাপাল্টা’ কিছু না লেখার জন্য বলেন।
অভিযুক্ত ‘সুপার ফাইভ’ কমিটির আহ্বায়ক আইয়ূব খান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অনুমতি নিয়েই তারা পুকুর ভরাট করছেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতারাও তাকে পুকুর ভরাট করার জন্য বলছেন। তবে অন্যায় কিছু করে থাকলে ভরাট বন্ধ করে দেবেন বলেও জানান তিনি।
তবে ভরাটের অনুমতি দেয়ার কোনো এখতিয়ার নেই বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌসুমি বাইন হীরা।
বিএনপি নেতা জাকির হোসেন বলেন, ভরাটের বিষয়ে আমি অবগত নই। আমি অবৈধ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নই। কবরস্থানের জায়গা ভরাট করা হচ্ছে জানি তবে কতদূর ভরাট করা হচ্ছে সেটা জানি না।
আশুগঞ্জ সারকারখানার উপ-মহা ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, পুকুরে আমাদের জায়গা রয়েছে। ভরাটকারীদের বাধা দিলে তারা বলছে আমাদের জায়গা ভরাট করা হচ্ছে না। প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার লোকজনও তাদের পক্ষে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজিব জানান, পুকুর ভরাট শুরু করার পরই আমি তাদের নোটিশ দিয়েছি। যে জায়গা ভরাট করা হচ্ছে সেখানে আশুগঞ্জ সারকারখানা ও খাদ্য অধিদফতরের সাইলোর জায়গা রয়েছে। তারা তাদের জায়গা ভরাট করার অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, কাউকে পুকুর ভরাটের অনুমতি দেয়া হয়নি। সারকারখানা এবং সাইলো কর্তৃপক্ষকে বলেছি তাদের জায়গা তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। ইউএনও তাদেরকে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছেন।
আজিজুল সঞ্চয়/এফএ/পিআর