রাজশাহীর মাদক ব্যবসায় সরাসরি পুলিশ জড়িত!
দেশের অন্যতম মাদক ট্রানজিট রাজশাহী। পাশের দেশ ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিদিনই ঢুকছে কোটি টাকার মাদক। মাঝে মধ্যে দু'একটি মাদকের চালান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটকালেও থেমে নেই মাদক প্রবাহ। অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় সদস্যের মাদক সম্পৃক্তরায় চেষ্টা করেও মাদক নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না পুলিশ।
আরও অভিযোগ রয়েছে, এখনকার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য মাদকসেবী। এদের কেউ কেউ সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। আবার কেউ কেউ মাদক ব্যবসায়ীদের কারবার চালিয়ে যেতে নানাভাবে সহায়তা দেন। কারও কারও বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য।
তবে মাঝে আশা জাগিয়েছিল পুলিশের ‘নতুন জীবন’। মাদক পরিত্যাগকারীদের নিয়ে এ সংগঠনটি গড়েছিল রাজশাহী নগর পুলিশ। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে এ উদ্যোগ নেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ১৮ জুন থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত রাজশাহীতে ছিলেন তিনি।
ওই সময়ের মধ্যে ঘটা করে আত্মসমর্পণ করেন ৩১৩ জন মাদক ব্যবসায়ী। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করায় ওই ১১৭ জনকে সেলাই মেশিনসহ আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়। জেলা পুলিশের কাছেও ঘটা করে আত্মসমর্পণ করেন কিছু মাদক ব্যবসায়ী।
তবে বছর না ঘুরতেই এদের অনেকেই আবারও ফিরে গেছেন আগের কারবারে। কৌশল বদলে আগের পেশায় গেছেন কেবল পুলিশের চাপেই। আবার যারা ফেরেননি তারাও রয়েছেন চাপের মুখে। গত বছর মাদক পরিত্যাগকরীদের জিম্মি করে বিপুল অর্থ আদায়ের অভিযোগ ওঠে এক ডজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে নগর পুলিশ। আর জেলা পুলিশের এমন খবর নেই।
অভিযোগের পাহাড় মাদকের স্বর্গরাজ্য গোদাগাড়ী মডেল থানার তৎকালীন ওসি হিপজুর আলম মুন্সির বিরুদ্ধে। মাদক ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, গ্রেফতারের পরও ছেড়ে দেয়া, আলামত পরিবর্তন, চার্জশিটে দায়মুক্তি, মাদকসহ গ্রেফতারের পর লঘু ধারায় আদালতে নেয়া এমনকি এজাহার পাল্টে দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আর এসব করেছেন তিনি মোটা অর্থের বিনিময়ে।
তার এ কর্মকাণ্ডে জেলা পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার ইন্ধনের অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে জেলা, রেঞ্জ ও পুলিশ সদর দফতর অধিকাংশ অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পায়। পরে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় ঢাকা পিবিআইতে।
একই দিনই বদলি করা হয় চারঘাট মডেল থানা পুলিশের ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মনকেও। তার বিরুদ্ধেও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিলো। কিন্তু অল্প দিনের মাথায় হিপজুর ফিরে আসেন নগর পুলিশের রিজার্ভ অফিসার হিসেবে। অভিযোগ রয়েছে, এখানে থেকেও গোদাগাড়ীর মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন তিনি। নিয়মিত মাদক সেবনেরও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের একই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
কনস্টেবল জিয়াউর রহমান ও নাজিম উদ্দিনও নিয়মিত মাদকসেবী। গত বছরের ৬ অক্টোবর এখানকার অন্যতম মাদক স্পট পবার সোনাইকান্দি এলাকা থেকে ১৫ বোতল ফেনসিডিল নিয়ে শহরে ফিরছিলেন এ দুজন। সেখানেই তাদের গ্রেফতার করে দায়িত্বরত বিজিবি। পরে মাদক আইনে তাদের বিরুদ্ধে পবা থানায় মামলাও হয়। এ দুই অভিযুক্ত ওই সময় রাজশাহী পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন।
দুর্গাপুরের দেবীপুরে মাদক ব্যবসায়ী শাহাবুলের স্ত্রীকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখান জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এএসআই মতিয়ার রহমান। ওই বছরের ১৬ নভেম্বরের এ ঘটনায় তাকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ।
অভিযোগের আঙুল নগরীর কাটাখালি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আখতারুজ্জামান, চার এএসআই জাহিদ, আব্দুল আজিজ, আরিফুল ইসলাম আরিফ ও সাইদুর রহমান এবং এটিএসআই মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধেও। তারা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে ছেড়ে দেন। গত বছরের ২ অক্টোবর থেকে ২ ডিসেম্বর এমন কাণ্ড ঘটায় এ কজন পুলিশ কর্মকর্তা।
গত ফেব্রুয়ারিতে ২০ কেজি গাঁজা জব্দ করেন নগরীর তালাইমারী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আখতার ও বোয়ালিয়া থানা পুলিশের এএসআই সৌমিত্র। জব্দকৃত মাদক থানায় জমা না দিয়ে তারা নিজেদের হেফাজতেই রাখেন তারা। এ সময় টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন মাদক ব্যবসায়ীদের। জানতে পেরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের কাছ থেকে এসব মাদক উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৩ এপ্রিল সাময়িক বরখাস্ত এ দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
মাদক ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে গত ২২ মার্চ ইমরান আলী (২৫) নামের এক মোটরসাইকেল মেকানিককে আসামি করে আদালতে তোলে পুলিশ। নগরীর কাটাখালি পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আজিজুর রহমান ও এএসআই জাহাঙ্গীর এ ঘটনা ঘটান। এ নিয়ে গত ২২ মার্চ ইমরান আলীর স্ত্রী শারমীন আক্তার আরএমপি কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
মাদক ব্যবসায় সহায়তার অভিযোগে গত ১৩ এপ্রিল প্রত্যাহার হন জেলার মোহনপুর থানা পুলিশের এসআই ওসমান গণি। আগের কর্মস্থল পবা থানার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী আবদুস সালেক ওরফে হেলালের সঙ্গে সখ্যতা ছিল তার। তার সঙ্গে মাদক ব্যবসাও চালাতেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। বিপুল পরিমাণ মাদকসহ র্যাবের হাতে হেলাল গ্রেফতারের পর থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে।
এর চারদিনের মাথায় নগরীর সিটিবাইপাস এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ এক কর্মকর্তার ছেলেকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠে নগর ডিবির এএসআই তসলিমের বিরুদ্ধে। পরে অবসরপ্রাপ্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তা নগর পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
গত ২৫ এপ্রিল প্রত্যাহার করা হয় নগরীর বায়া ফাঁড়ির ইনচার্জ মিজানুর রহমানকে। তার বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতাসহ নানান গুরুতর অভিযোগ ছিল। এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগ পেয়ে তাকে প্রত্যাহার করে আরএমপি।
গত ১৮ মে তানোরের মুন্ডুমালা পৌরসভার মাহালিপাড়া থেকে চার মাদক বিক্রেতাকে ধরেও ছেড়ে দেয় পুলিশ। মুন্ডুমালা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই কাওসার আহমেদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠে। বিপুল পরিমাণ চোলাই মদসহ সেখানকার সুনিল, নিতাই, ডালিম এবং বিপিন ওরফে গুডুকে গ্রেফতার করেন কাওসার। পরে মোটা অর্থের বিনিময়ে তাদের ছেড়েও দেন।
পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগ আরও দীর্ঘ। অভিযোগ পাবার পর গোপনে তদন্ত করে সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। তবে অনেক সময় অভিযোগ না পাওয়ায় পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা।
রাজশাহী জেলা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এ কবছর জেলা পুলিশের ৯২৮ সদস্য অপরাধে জড়িয়েছেন। এর মধ্যে ৫৪ জনকে গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে। মাদক সম্পৃক্ততা, উৎকোচ গ্রহণ, দায়িত্বে অবহেলা এমনকি পারিবারিক বিষয়ে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন এরা। শাস্তি হিসেবে ব্লাক মার্ক, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, পদাবনতি ও বেতন কর্তন করা হয়েছে। এছাড়া চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দুই অভিযুক্তকে।
একই সময় গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে নগর পুলিশের ৭০ সদস্য। এদের মধ্যে মাদক সম্পৃক্ততায় অভিযুক্ত হয়েছে তিনজন। বাকিরা অভিযুক্ত হয়েছে উৎকোচ গ্রহণ এবং দায়িত্বে অবহেলাসহ নানান অভিযোগে। মাদক সম্পৃক্ততায় অভিযুক্তদের একজনের ব্লাক মার্ক এবং দুজনের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, মাদক ইস্যুতে সব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি পুলিশের। কেবল মাদক ব্যবসায়ী নন যে সকল পুলিশ সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
নগর পুলিশের রির্জাভ অফিসার হিফজুর আলম মুন্সির মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ইফতেখায়ের আলম বলেন, তাদের কাছে এমন অভিযোগ নেই। তবে বিষয়টি তারা নজরদারিতে রাখবেন।
আর হিফজুর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও সিরিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক খান। তিনি বলেন, গোদাগাড়ী থানার তৎকালীন এ ওসির বিরুদ্ধে ওঠা কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। সত্যতাও পাওয়া গেছে। তিনি নিজেও কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত করছেন। মাদক প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এমএএস/পিআর