অনাবৃষ্টির কবলে রংপুর : দিশেহারা কৃষক
শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়েও কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় রংপুরের আমন চাষিরা পড়েছেন মহা বিপাকে। চলতি মৌসুমে পরিমিত বৃষ্টির পানি না পাওয়ায় ক্ষেত পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফসল বাঁচাতে বাধ্য হয়ে কৃষক সেচের মাধ্যমে পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। এতে করে খরচের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ পর্যন্ত অর্ধেকেরও কম জমিতে আমন চারা রোপণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো সময় রয়েছে বলে দাবি করছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞের মতামত, ফলন বিপর্যয় না হলেও খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি আমন মৌসুমে রংপুর জেলায় হাইব্রিড, উফশী এবং স্থানীয় জাত মিলে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে আমন চাষ এবং ৪ লাখ ৪২ হাজার ৮শ ৯৭ মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে ২৯ জুলাই পর্যন্ত জেলায় আমনের আবাদ হয়েছে ৫৮ হাজার ১১০ হেক্টর।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জাগো নিউজকে জানান, আগামী আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমনের আবাদ চলবে। ইতোমধ্যে গ্রাম পর্যায়ে কৃষকদের সেচের মাধ্যমে হলেও আমন চাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত বছর এই সময় পর্যন্ত ৪০ হাজার ২শ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়েছিল। যেহেতু হাতে এখনো সময় রয়েছে তাই আশাহত হবার কোনো কারণ নেই। জমিতে রস থাকলে আমন ক্ষেতে তেমন ক্ষতি হবে না। তবে অতিরিক্ত শুকিয়ে গেলে ফলন ব্যাহত হতে পারে। তবে এখনও সেই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
এদিকে, বৃষ্টিপাতের অভাবে আমন আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। গত ১০ দিন থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় অনেকে সেচের মাধ্যমে রোপা আমনের আবাদ অব্যাহত রাখলেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা আকাশের পানির দিকে চেয়ে রয়েছেন। ফলে বোরো আবাদের চেয়ে আমন আবাদ সাশ্রয় হলেও শুধু বৃষ্টির অভাবে এ বছর আমনের উৎপাদন খরচ অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেছেন কৃষকেরা।
রংপুর নগরীর ১৫ নং ওয়ার্ডের ঘাঘটপাড়া এলাকার কৃষক মানিক জাগো নিউজকে জানান, এ বছর ৫ দোন ( ১ দোন = ২৫ শতক) জমিতে নেপালী গুটি স্বর্না জাতের ধান রোপণ করেছেন তিনি। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত ১০ দিনে সেচের ব্যবস্থা করতে শ্যালো মেশিন নিজস্ব হওয়া সত্ত্বেও তার ডিজেল কেনা বাবদ ১ হাজার ৮শ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। তবুও কাঙ্খিত পানির অভাবে ধান গাছ বঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য। এদিকে যাদের নিজস্ব সেচ যন্ত্র নেই তারা প্রতি ঘণ্টায় ১শ থেকে দেড়শ টাকায় পানি কিনে জমিতে সেচ দিচ্ছেন।
ওই ওয়ার্ডের শাহপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদুল, খোরশেদসহ অনেকেই জাগো নিউজকে জানান, গত ৩ দিনে পানি কিনতে ৭শ টাকা করে খরচ হয়েছে তাদের। তবুও জমি আবাদযোগ্য হয়নি।
তারা আরও বলেন, বৃষ্টির পানির তুলনায় সেচের পানি দিয়ে জমি আশানুরূপভাবে ভেজানো যায় না। এ কারণে ফলন কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি পাকুড়িয়া শরীফ এলাকার কৃষক ইসলাম উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, এ বছর ১শ শতক জমিতে বি আর-১১ আবাদ করলেও প্রায় ৫০শতক উচু জমি পানি দিয়ে তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
কাউনিয়ার উপজেলার মীরবাগ এলাকার কৃষক সেকেন্দার আলী জাগো নিউজকে জানান, ১ দোন জমিতে আমন আবাদ করতে প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ লাগে। সেচের মাধ্যমে পানি দিলে ১ হাজার ২শ থেকে ১ হাজার ৪শ টাকা অতিরিক্ত খরচ বৃদ্ধি পায়। সে তুলনায় ধানের দাম আশারনুরূপ না হলে লোকসান গুণতে হবে তাকে।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যান বিশেষজ্ঞ খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমন আবাদে সেচ ও সার কম লাগে এবং আগাছা হয় না বলে উৎপাদন খরচ তুলমামূলক কম হয়। এখনো ১৫ দিনের মত আমন আবাদের সময় হাতে রয়েছে। এসময়ের মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালেদ শারফী জাগো নিউজকে বলেন, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে গভীর নলকূপ স্থাপন, যথাযথ বৃক্ষ রোপণ না করা, পানি চক্রে ভূ-পৃষ্টে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং ঋতু চক্রের পরিবর্তনসহ নানা কারণে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। কষ্ট করে হলেও কৃষক আমন আবাদ টিকিয়ে রেখেছেন। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন আবাদের ফলনে তেমন একটা বিপর্যয় না ঘটলেও খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা।
রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্র মতে, গত বছর জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০৭.০৬ মিলিলিটার। সে তুলনায় চলতি জুলাই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৫৩ মিলিলিটার থাকলেও বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৩৩ মিলিলিটার। গত জুন মাসে ৪৩৭ মিলিলিটারের পরিবর্তে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫২৪ মিলিলিটার। গত তিন দিনে এ অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬.০২ থেকে ৩৬.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করেছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে জানান, কক্সবাজার সামুদ্রিক এলাকায় নিম্নচাপ শুরুর কারণে এ অঞ্চলে কিছুটা বৃষ্টিপাত হবে। কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত হলে কৃষকরা ভীষণ উপকৃত হবেন।
এমজেড/এমএস