ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

‘কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাতেই সাতকানিয়ার দুর্ঘটনা’

জেলা প্রতিনিধি | চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ০২:২৭ এএম, ১৫ মে ২০১৮

সাতকানিয়ায় ইফতার সামগ্রী সংগ্রহ করার সময় ‘পদদলিত’ হয়েই ১০ নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদিও ঘটনার পরপরই পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘হিটস্ট্রোক’ বলে প্রচারণা চালানো হয়। তবে স্থানীয়রা বলছেন, কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনাতেই এ দুর্ঘটনা।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ইফতার সামগ্রী সংগ্রহ করার সময় সকাল ১০টার দিকে অস্থায়ী গেটের কাছে হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়। একজন আরেকজনকে পেছনে ফেলে ইফতার সামগ্রী সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে অস্থায়ী গেটটি ভেঙে পড়ে। এসময় ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে সামনে যারা ছিল তারা পদদলনের শিকার হন। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৮ নারী ও শিশু। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় আরো দু’জনের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাতকানিয়া নলুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জাহাঙ্গির কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে থেকে বলা হচ্ছিল আজ ইফতার দেবে। তাই সাতকানিয়া ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে হাজার হাজার মানুস ভিড় করে মাদরাসা মাঠে। কিন্তু সে অনুপাতে কোনো ব্যবস্থাই ছিল না ওই এলাকায়। অনেকে রাত জেগে অপেক্ষার পর সকালে আগেভাগে ইফতার সামগ্রী না পেয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েন। এর মাঝেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। এতেই প্রাণ হাড়ান ১০ নারী।’

স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, এমন ঘটনা নতুন নয়; ২০০৫ সালে একইভাবে কেএসআরএমের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহজাহানের পক্ষ থেকে দেয়া ইফতার সামগ্রী সংগ্রহ করার সময় পদদলিত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়।

সোমবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নে শিল্পগ্রুপ কবির স্টিলের (কেএসআরএম) মালিক মো. শাহজাহানের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাসলিমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের গাটিয়াডাঙ্গা গ্রামের হাঙ্গরমুখ এলাকার কাদেরিয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদরাসা প্রাঙ্গণে ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।’

ওই সময় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) এ কে এম এমরান ভূঁইয়া বলেন, ‘৩০-৪০ হাজার মানুষ ইফতার সামগ্রী নিতে ওই বাড়িতে ভিড় করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও কক্সবাজার জেলা থেকে লোকজন সেখানে আসে। অব্যবস্থাপনার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।’

কিন্তু সোমবার বেলা ২টার দিকে সাতকানিয়া সার্কেলের এসপি জাসানুজ্জামান মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিহতদের সবাই নারী। অতিরিক্ত ভিড়ে হিট স্ট্রোকে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

এছাড়া সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল আলম বলেন, ‘স্থানীয় এক ব্যক্তির জাকাত দেয়ার খবরে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কমপক্ষে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন। এর মধ্যে অনেকে গতরাত থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সকালে ওই ভিড় আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত ৯ জন নারীর মৃত্যুর খবর পাই। অতিরিক্ত ভিড়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হিটস্ট্রোকে ১০ নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে।’

এখানেই থেমে থাকেনি সাতকানিয়া থানা পুলিশ। এরপরে সাতকানিয়া থানার পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘ওই নারীদের ‘হিটস্ট্রোকে’ মৃত্যু হয়েছে’।

এদিকে একই স্থানে বারবার এমন ঘটনা ও ঘটনার পর প্রশাসনের লুকচুরি দারুণ অসন্তুষ্ট চট্টগ্রামের সচেতন মানুুস। তারা বলছেন, সোমবার ইফতার দেয়া হবে এ বিষয়টি জেনে সুদূর বান্দরবান ও কক্সবাজার থেকে মানুষ এসেছে। কিন্তু পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ পর্যপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি। এখন সেই দোষ ঢাকার জন্য ‘হিটস্ট্রোকে’ মৃত্যুর গল্প ফেঁদেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান হলো সংযমের মাস, কিন্তু দাতা-গ্রহীতা সবাই এখানে অসংযমের পরিচয় দিয়েছে। আর প্রশাসনের কথা কী বলবো, ওরাতো এতগুলো মানুষ মারার পরও বলছে ‘হিটস্ট্রোক’! এর আগেও ওই জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। আবুল খায়েরের ইফতার নিতে গিয়েও অনেক মানুষ মরেছে। সেটা ছিল চট্টগ্রামের প্রথম ঘটনা।’

অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘ঠিক কত টাকার ইফতারি দেবেন ওই লোক? কেনইবা এভাবে লোক দেখানো মানুষ জোগার? প্রশাসনের উচিত এখনই ঘটনার জন্য দায়িদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।’

এদিকে এ ঘটনায় প্রশাসনের লুকোচুরি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। একজন লিখেছেন, ‘আজ সকালে নলুয়ার তাপমাত্রা কি ৫০ ডিগ্রি ছিল? যে হিটস্ট্রোকে এত মানুষ মারা গেল?

এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের ছালেহ আহমদের মেয়ে টুনটুনি বেগম (১৫), আব্দুল হাফেজের স্ত্রী জোসনা আক্তার (৫০), মো. আলাউদ্দিনের মেয়ে নুর জাহান (১৮), সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের ছগির আহমেদের মেয়ে হাছিনা আক্তার (৩৫), আহমদ শফির মেয়ে রশিদা আক্তার (৫৪), একই উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের মো. হাসানের স্ত্রী রিনা বেগম (৩২), আবুল কালামের স্ত্রী সাকি আক্তার, চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভার নুরুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৬০) এবং বান্দারবানের মো. ইব্রাহীমের স্ত্রী নুর আয়েশা (৬০)।

সকালে এ ঘটনার পর বিকেল ৫টার দিকে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জাগো নিউজকে জানান সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্লা।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনার ঘটার পর নিহতদের মরদেহ কাঠিয়াডাঙ্গা গ্রামের কাদেরিয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদরাসার একটি কক্ষে রাখা হয়। পরে প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হলে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।’

এদিকে এ ঘটনা তদন্তের পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাশহুদুল হকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন ছাড়াও জনপ্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটি আগামী সাতদিনের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেবেন।

বিএ

আরও পড়ুন