সবুজ পাহাড়ে রক্তের দাগ, ৫ মাসে ১৮ খুন
রাঙ্গামাটির সবুজ পাহাড়ে গত ৫ মাসে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছেন অনেকে। পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের শিকার হয়েছেন তারা। একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে পাহাড়। এতে আতঙ্কে দিন পার করছেন পাহাড়ে বসবাসকারীরা।
গত বছরের ১ ডিসেম্বরের ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়াম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা পাহাড়ে আবার আগুন জ্বালাবে। তার এ ঘোষণার চারদিন পরেই ৫ ডিসেম্বর নানিয়ারচর সতেরোমাইল ও আঠারোমাইলের মধ্যবর্তী চিরঞ্জীব দোজরপাড়া এলাকার নিজবাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়ে ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্য অনাধি রঞ্জন চাকমাকে (৫৫)। এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে অনাধি সমর্থিত দল ইউপিডিএফ (প্রসিত)।
ওই দিন রাঙ্গামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে দায়ী করে। এছাড়া ওইদিনই আবার বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাসেল মার্মাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। একদিন পর ৭ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি শহরে নিজ বাসায় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভানেত্রী ঝর্ণা খীসাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে ১৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গায় ইউপিডিএফকর্মী ও সংগঠক অনল বিকাশ চাকমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ (প্রসিত) এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে।
এদিকে চলতি বছরের শুরুতেই ৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বরায় তংচঙ্গ্যাকে গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার জন্য যুবলীগ জেএসএসকে দায়ী করে। ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিঠুন চাকমাকে। একইভাবে ইউপিডিএফ এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করেন।
৩০ জানুয়ারি বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এ ঘটনাতেও জেএসএসকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটি শহরে ছাত্রলীগ নেতা সুপায়ন চাকমাকে মারধর করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর্মীরা। প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে হরতাল পালন করে ছাত্রলীগ। ২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও ইউপিডিএফ (প্রসিত) সমর্থিত কর্মী ছিলেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ (প্রসিত) কর্মী দীলিপ কুমার চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ইউপিডিএফের হরিনাথ পাড়ার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে ১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের (প্রসিত) কর্মী নতুন মনি চাকমাকে।
১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুবছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ (প্রসিত) সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। প্রায় এক মাস পরে ১৯ এপ্রিল মুক্তি পান তারা দুইজন। এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে ইউপিডিএফ (প্রসিত)।
১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যান রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফের (প্রসিত) এক সদস্য। এ হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জেএসএসের (এমএনলারমা) দুই কর্মীকে হত্যা করা হয়। তারা হলেন- পঞ্চায়ন সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমা (২৯)।
১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হন। তিনিও ইউপিডিএফর দুই গ্রুপের বিরোধের কারণে প্রাণ হারান। ২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসের (এমএন লারমা) মধ্যে গোলাগুলিতে সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামে এক ইউপিডিএফ সমর্থিত কর্মী নিহত হন।
সর্বশেষ গত ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ে সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমাকে। এসময় তার সঙ্গে থাকা সংগঠনটির আরেক নেতা রূপম চাকমাও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এর একদিন পর ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের শীর্ষ নেতা আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা। একই সঙ্গে দলটির নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, তনক চাকমা এবং তাদের গাড়িচালক সজীব।
এ সব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাঙ্গমাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জাগো নিউজকে বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা এবং বেপরোয়া হত্যার ঘটনাকে সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। আমরা তৎপর রয়েছি, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ কাজ করে যাবে। পাহাড়ের এ সংঘাত বন্ধে এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
আরএ/এফএ/এমএস