জীবন বাঁচাতে ছুটে চলা মুহিতের গল্প
বিলাসিতায় মোড়ানো স্বপ্নকে পেছনে ফেলে মানুষের সঙ্গে থাকার ইচ্ছে ছিলো মুহিতের। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় জীবনে টানাপোড়েন ছিল না কখনোই। তবুও সব ছেড়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর আনন্দকেই বেছে নিয়েছেন মুহিত। নিজের পরিবারের কথা না ভেবে ছুটে চলেছেন প্রতিনিয়ত। প্রবল ঝড়, বৈরি আবহাওয়া এমনকি গভীর রাতের আয়েশি ঘুম কোনো কিছু আটকাতে পারে না অ্যাম্বুলেন্স চালক মুহিতকে।
মুহিতের পুরো নাম মুহিতুল ইসলাম। তার জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার অচিন্তপুরে। বাবা ছিলেন সুনামগঞ্জের জগাইরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পরিবারের অবস্থা আর ১০টা পরিবারের চেয়ে ভালোই ছিল। বাবা চেয়েছিলেন মুহিত বড় হয়ে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন। বড় কোনো চাকরি না হয় ব্যবসা করবেন তিনি। কিন্তু মুহিত চেয়েছিলেন অন্যকিছু। স্বপ্নগুলোকে একটু আলাদা করে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৯২ সালে তিনি জেলার জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে যোগদান করেন। তখন তার বয়স ২২ বছর। ১৯৯৩ সালে দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। একই বছর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগত রোগীদের চিকিৎসার জন্য মুহিতকে কক্সবাজারের সিভিলসার্জন কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি জাতিসংঘ প্রদত্ত অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা করতেন। উন্নত সেবার জন্য রোগীদের নিয়ে যেতেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এরপর আবারও ফিরে আসেন সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে। এখনও এখানেই আছেন।
মুহিত বলেন, এইতো সেদিন একজন ডেকে বললেন ‘ভাই ১৯ বছর আগে একদিন অনেক বৃষ্টি ছিলো মনে আছে? আপনি আমার স্ত্রীর জীবন বাঁচিয়েছেন, সঙ্গে আমার সন্তানেরও। সেদিন আমার কন্যা সন্তান হয়েছিলো, এখন সে হাইস্কুলে পড়ে। তার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে হলে আপনার কাছে আমাদের ঋণের কথাও মনে পড়ে যায়। সেদিন এমন বৃষ্টি ছিলো আর আবহাওয়া এতো খারাপ ছিলো যে আপনি যদি সঠিক সময়ে না আসতেন আর আমাদের সঠিক সময়ে হাসপাতালে না পৌঁছে দিতেন তাহলে আমার সব শেষ হয়ে যেতো। আমি সারা জীবন আপনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাবো।’
‘লোকটার কথা শুনেই মনটা ভরে গেলো। এরকম অনেকেই যখন বলেন তখন মনে হয় যে এই পেশায় আমার জীবনটা স্বার্থক। কিছু করতে পারি আর না পারি জীবনে মানুষের উপকারে আসতে পেরেছি। সেটাই আমার জন্য অনেক বড়কিছু’ বললেন মুহিত।
মুহিত আক্ষেপ করে বলেন, ‘যখন কেউ একটা অ্যাম্বুলেন্সকে সাইড দিতে চায় না তখন মানুষের বিবেকবোধ নিয়ে ভাবি। সড়কের মাঝখানে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝামেলা করে গাড়ি থামিয়ে রাখে, পেছনে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে দেখলেও তাদের কাছে বিষয়টা তেমন গুরুত্ব পায় না। অনেকেই বেপরোয়া হয়ে নিজেদের গাড়িগুলো চালান, অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গেও পাল্লা দিতে তারা মজা পান হয়তো! কিন্তু তিনি বা তারা যদি রোগীর জায়গায় থাকতেন তাহলে বুঝতে পারতেন রোগীরা কতটা অসহায়। তাই তাদের কাছে অনুরোধ অন্তত অ্যাম্বুলেন্সকে সাইড দিন। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সড়কটা ছেড়ে দিন; একজন মানুষের জীবন বাঁচান।’
এফএ/এমএস