‘বাচ্চা চুরি করে পালাচ্ছি ভেবে পুলিশ আটকে রাখে’
‘২০১৬ সালের মাঝামাঝির দিকে মহেশখালীর এক যুবককে প্রতিপক্ষের লোকজন পেটে ক্ষুরের আঘাত করে। এতে তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে আনা হলে কোনো মতে পেট সেলাই করে পাঠিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। চকরিয়ার আজিজনগর এলাকায় গিয়ে দেখি তার পেটের সেলাই খুলে গিয়ে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে স্ট্রেচারের নিচে পড়ে গেছে। তা দেখে গাড়িতে থাকা যুবকের মা, পুলিশ ও নার্স সবাই অজ্ঞান। গাড়ি পার্ক করে নাড়িভুড়ি পজিশন মতো বসিয়ে গামছা ও বেডসিট দিয়ে পেট বেঁধে দ্রুত চমেক হাসপাতালে পোঁছাই। সেখানেই গিয়েই চিকিৎসকরা বললেন রক্ত লাগবে। ‘ও’ পজেটিভ রক্ত মিলে যাওয়ায় আমি তাকে রক্তও দিলাম। ওই যুবক এখন সুস্থ।’
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের গাড়ি চালক নুরুল আনোয়ার (৩৮) তার পেশাগত জীবনের স্মৃতি উল্লেখ করে এ কথাগুলো বলেন।
তিনি জানান, চাকরির ১৪ বছরে তিনি কয়েক হাজার আহত ও মুমূর্ষু রোগীকে চমেক হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু লোক মারা গেছেন আর অধিকাংশই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। যারা বাড়ি ফিরেছেন তাদের দেখলে মনটা আনন্দে ভরে উঠে তার। বিশেষ করে প্রসূতি মা যখন সুস্থ হয়ে শিশুসহ বাড়ি ফিরে আর স্বজনরা তার মতো ক্ষুদ্র এক চালককে খুঁজে কৃতজ্ঞতা জানাতে আসে তখন আনন্দে চোখে পানি চলে আসে।
গাড়ি চালক নুরুল আনোয়ার বলেন, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে কক্সবাজার স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকার সনাতন ধর্মালম্বী এক ব্যবসায়ীর স্ত্রীর সন্তান প্রসবের ব্যাথা উঠলে সদর হাসপাতাল আনা হয়। রাতে ডেলিভারি করতে গিয়ে দেখেন পেটে থাকা জমজ বাচ্চার পজিশন নড়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ চমেক হাসপাতালে রেফার করেছেন। রাত ২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওয়ানা হলাম। চকরিয়া উপজেলার সীমানায় ঢুকার পরপরই দেখি বাচ্চা দুটি স্ট্রেচারেই প্রসব হয়ে গেছে।
গাড়ি পার্ক করে মা ও বাচ্চা দুটিকে গুছিয়ে রেখে দ্রুত চলছি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখে মাকে চকরিয়া জমজম হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাচ্চা দুটোকে অক্সিজেন দিয়ে দ্রুত চমেক হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে ছুটছি। পথে বিপত্তি ঘটায় পুলিশ। লোহাগাড়া গিয়ে পুলিশ গাড়ি আটকে দেয়। পথের কাহিনী বলার পরও বাচ্চা চুরি করে পালাচ্ছি ভেবে তারা প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখে। বাচ্চার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ে পরে ছাড়া পাই। হাসপাতালে পৌঁছাতে ফজর হয়। বাচ্চা দুটির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তাদের পাশেই অপেক্ষা করতে হয়। সকাল ১০টার দিকে তাদের স্বজন এলে বাচ্চা বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসি। এখন বাচ্চা দুটো একটু একটু হাটে।
তিনি আরও বলেন, ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগদানের পর চমেক হাসপাতালের পরিচালকের গাড়ি চালাতাম। তখন অবসরকালীন সময়টা জরুরি বিভাগে দিতাম শেখার উদ্দেশ্যে। দায়িত্বপালনরত সবাই যত্ন করে সবকিছু শিখিয়েছেন। সেখান থেকেই হাতেকলমে অর্জন করা জ্ঞান ২০১০ সালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল আসার পর আপদকালীন সময়ে কাজে লাগাতে পারছি।
পেশাগত অতৃপ্তির কথা বলতে গিয়ে নুরুল আনোয়ার বলেন, মানুষ অ্যাম্বুলেন্স নেয় দ্রুত পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু কক্সবাজার সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটি ফিটনেস হারিয়েছে। এটির চলাচল আড়াই লাখ কি.মি পার হয়েছে অনেক আগেই। বলতে গেলে জোড়াতালি দিয়েই চলছি। তাই সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে রাস্তায় কচ্ছপ গতিতে চলতে হয়। তখন বিরক্তি চলে আসে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে চালক মাত্র একজনই। সুপারের গাড়িও চালাতে হয়। অনেক সময় ভিআইপি ডিউটিও থাকে। তখন অ্যাম্বুলেন্স সেবা বঞ্চিত হন সাধারণ মানুষ। এটি মনে কষ্ট দেয়। আমার চাওয়া নিয়মিত চালকসহ একটি আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন দ্রুত গতির অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে সরবরাহ হোক।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পুঁ চ নু বলেন, চলমান অ্যাম্বুলেন্সটি পুরনো হয়ে গেছে। তাই আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন একটি অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া আছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বলেন, জেলা সদর ও উপজেলার সরকারি প্রতিটি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সেবা রয়েছে। ডাক্তারদের পাশাপাশি রোগীর জীবন বাঁচাতে সেসব গাড়ির চালকদের অবদানও কোনো অংশেই কম নয়।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/পিআর