শিক্ষার শেষ চূড়ায় পৌঁছাতে চায় শারীরিক ৩ প্রতিবন্ধী
শারীরিক তিন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অদম্য মেধাবী গল্প। উচ্চ শিক্ষার শেষ চূড়ায় পৌঁছাতে চায় ওরা। তাই শত বাধা পেরিয়ে এবার এইচএসসি জয়ের স্বপ্ন দেখছেন লালমনিরহাটের শারীরিক তিন প্রতিবন্ধী জান্নাতুল ফেরদৌসী, হাসিনা আক্তার এবং রুবেল মিয়া।
জান্নাতুল ফেরদৌসী জন্মের পর থেকে দুই হাতের কোনো আঙুল নেই। এরপরেও থেমে নেই তিনি। প্রাথমিকের ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। জেএসসিতে জিপিএ-৫ আর এসএসসিতে ৪.৮৯ পেয়ে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন জান্নাতুল। তিনি এবার হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন কলেজের মানবিক শাখার থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন এই অদম্য মেধাবী।
মঙ্গলবার তার পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুই হাতে আঙুল না থাকলেও তালুর সাহায্যে আর দশজন পরীক্ষার্থীর মতই দ্রুত লিখে যাচ্ছে জান্নাতুল। তার লেখাও অসম্ভব সুন্দর। এমন লেখায় কক্ষ পরিদর্শকরাও খুশি।
জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, শত বাঁধা পেরিয়ে আজ এইসএসসি জয়ের চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে বিএসএস (শিক্ষা ক্যাডার) জয় করে শিক্ষকতা করতে চাই।
সে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের মধ্য গড্ডিমারী গ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বুলুর মেয়ে।
হাসিনা আক্তার
লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া গ্রামের দিনমজুর শাহেদ আলীর মেয়ে হাসিনা আক্তার টাইফয়েডে ভুগে মাত্র তিন বছর বয়সে দুই চোখের দৃষ্টি হারায়। তবে পড়ালেখার অদম্য বাসনায় ভর্তি হয় লালমনিরহাট জেলা সদরের হাড়িভাঙা এলাকায় বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস পরিচালিত একটি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কেন্দ্রে। সেখান থেকে লালমনিরহাট চার্চ অব গড স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে জেএসসি এসএসসি জয় করে হাসিনা। এ বছর হাতীবান্ধা মহিলা কলেজের মানবিক শাখার শিক্ষার্থী হিসেবে স্থানীয় লেখকের সাহায্যে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে হাসিনা।
হাসিনা আক্তার জানায়, পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো গান গাইতে পারেন তিনি। পরিবারের অভাব অনাটনের কারণে তার কলেজে পড়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন হাসিনা আক্তার।
চোখের দৃষ্টি শক্তি না থাকায় দশম শ্রেণি পড়ুয়া সুলতানা তার কাছে শুনে এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র লিখছে। তাতে করে ফলাফল ভালো হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে অভিষ্যতে পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবে কিনা? এমন শঙ্কা কাটছে না হাসিনা আক্তারের।
হাতীবান্ধা আলিমুদ্দিন কলেজের কেন্দ্র সচিব ও অধ্যক্ষ সরওয়ার হায়াত খান বলেন, দুই হাতে আঙুল না থাকলেও জান্নাতুল খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী। কেন্দ্রে দুই প্রতিবন্ধী এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করবে বলে বিশ্বাস করি।
রুবেল মিয়া
ছোট বেলা আগুনে পুড়ে দুহাতের প্রায় সব আঙুল হারাতে হয় রুবেল মিয়াকে। বাকি যে দু একটি আঙুল অবশিষ্ট রয়েছে, সেটিও আবার বাকা। তাই লিখতে কষ্ট হলেও পড়ালেখায় পিছিয়ে নেই এই অদম্য মেধাবী। তিনি এ বছর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা উত্তরবাংলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে এইচএসসি পাশের স্বপ্ন আকঁছেন। তার বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার সুকানদিঘী এলাকায়।
কাকিনা মহিমা রঞ্জন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্র গিয়ে দেখা যায়, সেই ছোট বেলার আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্থ হাত দিয়ে আর দশজন শিক্ষার্থীও মতই এইচএসসির উত্তরপত্র লেখছেন রুবেল।
ওই কেন্দ্রের দায়িত্বরত কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রাশেদুল ইসলাম বলেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে আমি কিছুক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি যে, রুবেলের হাতের লেখা অত্যন্ত চমৎকার। পরীক্ষাও বেশ ভালো দিচ্ছে।
রুবেল মিয়া জানান, আমার দুই হাতের আঙুল পুড়ে যাওয়া লিখতে বেশ সমস্যা হয়। এরপরেও পুড়ে যাওয়া হাতে লিখে এ পর্যন্ত এসেছি। আশা করি এইচএসসিও পাশ করবো। এভাবে পড়ালেখা করে ভবিষ্যতে সরকারি চাকরি করতে চায় রুবেল।
রুবেলের মা মরিয়ম বেগম জানান, ১২ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে সুকানদিঘী বাজারে ছোট একটি লন্ড্রির দোকান দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়ার খরচ চালান রুবেল।
কাকিনা উত্তরবাংলা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদের চেয়ে বেশ মেধাবী রুবেল। ভবিষ্যতে সে আরও ভালো করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
রবিউল হাসান/আরএ/আরআইপি